Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নে ধীরগতি উদ্বেগজনক

প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, এজাতীয় কথা সরকারের তরফ থেকে প্রতিনিয়ত বলা হলেও উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র ও সূচক বিপরীতমুখী। সরকারের গৃহীত বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দের দিকে তাকালেই তার চিত্র দেখা যায়। অসংখ্য বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে ঠিকই, তবে সেগুলো কবে আলোর মুখ দেখবে, তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছে না। বিষয়টি এমন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা প্রাথমিক কাজ শুরুর চিত্র দেখিয়েই উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেয়া হচ্ছে। একে কথার উন্নয়ন ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! গত কিছুদিন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে হতাশ হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। উন্নয়ন প্রকল্প এবং তাতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও, সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি এতটাই ধীর যে কচ্ছপের গতিকেও হার মানায়। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নে রয়েছে। সরকার চেষ্টা করেও উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে না। চলতি অর্থ বছরে (গত জুলাই-জুন) উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ৯৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রথম সাত মাসে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। গত অর্থ বছরে তিন মাস রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও ব্যয় হয়েছিল ২৫ হাজার ৮৫৮ কোটি বা এডিপি’র ৩২ শতাংশ। এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও ব্যয় প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তার ব্যবহার এ অর্থবছরে কমেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন, প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও তার কোনো উন্নতি হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হচ্ছে না?
উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, অর্থ সংকট নেই এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, অথচ বাস্তবায়িত হচ্ছে নাÑ এমন নজির বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই। ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো। মাথাপিছু আয়ও ২ ডলার বেড়ে ১৩১৬ ডলার হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব যে উন্নয়নকে কথা দিয়ে টেনে নেয়ার শামিল, তা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরুর দিকে পড়ে থাকা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া এবং তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারার সক্ষমতা যদি না থাকে, তাহলে উন্নয়ন কোথায় হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, এ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অর্থ সংকট না থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ কোটি টাকার বেশি পাইপ লাইনে আটকে রয়েছে। ব্যাংকে একই পরিমাণ অর্থ অলস পড়ে আছে। এডিপির বাজেটও রয়েছে। এত অর্থ ব্যবহার করতে না পারা এবং পড়ে থাকার অর্থই হচ্ছে, উন্নয়নের গতি তেমন নেই। এই চিত্রের মধ্যেও প্রতি বছর এডিপির আকার বড় হচ্ছে। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আর্থিক বছর শেষে দেখা যায়, প্রকল্পের উন্নয়ন সিকিভাগ সমাপ্ত হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ শুরুই করা হয়নি। এই অসমাপ্ত প্রকল্পের অর্থ ফেরতও যাচ্ছে। যেটুকু ব্যয় হয়, তাতে দেখা যায়, অর্থবছর শেষে তড়িঘড়ি করে ব্যয় করা হয়। এই ব্যয় যতটা না প্রকল্পের কাজে ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি লোপাট হয় দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে। লুটপাট ও দুর্নীতির বিষয়টি এড়িয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবই মূল কারণ। প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সক্ষমতা থাকে না, সেখানে প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয় কেন? কেনই বা অযোগ্যদের দায়িত্ব দেয়া হয়? পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশটি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে এডিপি’র বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দেয়া হয়। প্রকল্পগুলোতে মোট এডিপি’র শতকরা ৭৩ ভাগই বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, খনিজ সম্পদ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ এবং রেলমন্ত্রণালয়। দেখা গেছে, চলতি অর্থ বছরের সাত মাসে এসব মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দকৃত অর্থের চারভাগের একভাগেরও কম ব্যয় করতে পেরেছে। বলাবাহুল্য, চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী দেখা যাবে, অর্থ বছরের শেষ দুয়েক মাসে এসব মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের অর্থব্যয়ের হিড়িক পড়েছে। এর মধ্যে যে দুর্নীতির বিষয়টি অবধারিত হয়ে উঠবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বাকী অর্থ ফেরত যাবে। পুনরায় নতুন অর্থবছরে অর্থবরাদ্দ করতে হবে। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে, তেমনি প্রকল্প ব্যয়ও দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থের এমন অপচয় বিশ্বে আর কোথাও দেখা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের অর্থ সময় মতো ছাড়ে বিলম্ব করা হয়। এটিও প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হয়ে রয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, অর্থ ছাড়ে ধীরগতি, সক্ষমতার অভাব- এসব সমস্যা নিয়ে প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়ার দরকার কি! এ কথা অনস্বীকার্য, এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন দেশের উন্নয়নের স্বার্থে জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যায় এবং অর্থের অপচয় হয়, সেসব প্রকল্প হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত করা হচ্ছে কেন? একদিকে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়, অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, এসব আলামত কি উন্নয়নের চিত্র হতে পারে?
যত দিন যাবে, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তত বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক ধারা। আমাদের দেশে সরকারের কথার উন্নয়ন দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃত উন্নয়ন পেছনের দিকে ধাবিত। স্বাভাবিক উন্নয়নের ধারাটিও বজায় থাকছে না। যথাযথভাবে এডিপির বরাদ্দ ব্যবহার করতে না পারা এবং বৈদেশিক সহায়তার অর্থ পাইপ লাইনে পড়ে থাকা ও ফেরত যাওয়া থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, উন্নয়নের চিত্র কি! আমরা অর্থ পেয়েও কাজে লাগাতে পারছি না। এমন দুর্ভাগ্য থেকে যেন কিছুতেই বের হয়ে আসা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে প্রতিটি অর্থের যথাযথ ব্যবহার এবং এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ ব্যবহারে সক্ষমতার অভাব, অর্থ ছাড়ে ধীরগতি এবং দুর্নীতির ক্ষেত্র সৃষ্টি করার- এ সংস্কৃতি বছরের পর বছর চলতে পারে না। প্রকল্প যথাযথভাবে ও যথাসময়ে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে আগে থেকেই সক্ষমতার সকল বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে কষ্টে রেখে এবং তার থেকে আদায়কৃত অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি করার এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়নে ধীরগতি উদ্বেগজনক

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন