পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে আর একটি গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরনার্থী হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ এবং ইউরোপের বিভিন্ন সীমান্তে প্রতিদিনই হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক মানবিক আশ্রয়ের জন্য ভীড় করছে। সিরীয় গৃহযুদ্ধ ৫ বছরে পদাপর্ণ করতে চলেছে। এরই মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আর ১৯ লাখ। সিরিয়ান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকা এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মানুয এই যুদ্ধে সরাসরি হতাহত হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। পাঁচ বছর আগেও সিরিয়া ছিল অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ। সেখানে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা বা সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কোন সংকট ছিল না। গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কুশীলবরা নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে।
ভয়াবহতা থেকে প্রাণে বাঁচতে সিরিয়া থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ স্থল ও সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। লাখ লাখ সিরীয় রিফিউজির চাপকে ইউরোপীয়রা রিফিউজি ক্রাইসিস নামে আখ্যায়িত করে সীমান্ত বন্ধ করতে অথবা সংকট মোকাবেলায় নানাবিধ আইনগত ও পুলিশি উদ্যোগ গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ভূমধ্য সাগরের তুরস্ক উপকূলে আইলান কুর্দি নামের এক তিন বছরের সিরীয় শিশুর লাশ সমগ্র বিশ্বের মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের মধ্যে আবেগ ও সহানুভূতির সঞ্চার করলেও যুদ্ধের নেপথ্য পরিচালকদের মনে এতটুকু রেখাপাত ঘটায়নি। সম্প্রতি এক থবরে জানা যায়, ইউরোপে সিরীয় অভিবাসীদের মধ্যে ১০ হাজারের বেশী শিশুর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ হওয়া এসব শিশু পশ্চিমাবিশ্বে শ্রমদাস, যৌনদাস অথবা অসামাজিক কর্মকা-ে ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। অনাকাক্সিক্ষত ও অস্বাভাবিক গৃহযুদ্ধে একটি সমৃদ্ধ জনপদকে অল্প কিছুদিনের মধ্যে শুধু ধ্বংস্তূপেই পরিণত করা হয়নি, সেই সাথে তার মত হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রের আত্মমর্যাদাশীল জাতিকে মানবিক অধিকার ও মর্যাদার চরম লঙ্ঘনের মুখে ঠেলে দেয়ার এই ন্যক্কারজনক পরিণতি মেনে নেয়া যায় না।
সিরীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের ভূমিকা নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক থাকতে পারে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং বিরোধী পক্ষের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগের বদলে অস্ত্র ও দমননীতির মাধ্যমে সমাধানের পথগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরুতেই এই ইস্যুটিকে জটিল করে তোলা হয়েছিল। অপরপক্ষে আইএস দমন এবং বাশার বিরোধী বিদ্রোহীদের সমর্থন এবং সিরিয়া সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ গ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবোধক। সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরিকতার ঘাটতি অনেকটা স্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের সদিচ্ছা থাকলে সিরিয়া এবং আইএস ইস্যুতে রাশিয়া, সউদী আরব, তুরস্ক, ইরানসহ আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সমঝোতামূলক অবস্থানে নিয়ে আসা অসম্ভব নয়। সিরিয়ায় রাশিয়ার সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এবং জয়-পরাজয়ের চালচিত্র পাল্টে গিয়েছে। আইএস এবং বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আলেপ্পোসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বাশারের অনুগত বাহিনী পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক বিপর্যয় রোধে কৌশলগত যুদ্ধ বিজয় বা পোড়ামাটি নীতি কোন গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ নয়। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সিরীয় জনগণের নিরাপত্তা, আকাক্সক্ষা ও শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতার কথা ভাবতে হবে। মার্কিনী মধ্যস্থতায় গত দুই দশকেও আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনা ও শান্তি প্রক্রিয়ার ফলাফল শূন্য। উপরন্তু ইসরাইলীরা এখনো অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে, মাঝে মধ্যেই বিমান হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনী জনপদ এবং শিশুদের হত্যা করছে। সিরিয়া যুদ্ধকে একটি গ্রেটার আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পরিণত করার যে কোন গোপন নীলনকশা আরব নেতারা ব্যর্থ করে দেবেন এটাই সকলের প্রত্যাশিত। আরব ও পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই সকলের কাম্য। মিউনিখে চলমান সিরীয় শান্তি আলোচনায় পরাশক্তিগুলো একটি ইতিবাচক ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে, এই মুহূর্তের এটাই একমাত্র প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।