পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি মানুষেরা তাদের অর্জিত যে অর্থ আমাদের দেশে প্রেরণ করে, আমরা তাকে রেমিট্যান্স বলি। এটা আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ যোগান দেয় এই রেমিট্যান্স। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একই সাথে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রেমিট্যান্স একই সঙ্গে অর্থনীতির প্রাণশক্তি এবং চালিকা শক্তি। রেমিট্যান্সই ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের প্রধান অংশ। আমদানির বিপরীতে বৈদেশিক দেনা পরিশোধে এই রেমিট্যান্স প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বিদেশে কর্মরত লাখো মানুষের ঘাম ঝরানো শ্রমে অর্জিত টাকা দেশকে বছরের পর বছর ধরে উন্নত করে চলেছে। তাদের পাঠানো টাকায় সচল আমাদের অর্থনীতির চাকা এবং সচল আমাদের জীবন। টাকা তাদের পরিবারের লোকজনের জীবনকে যেমন করছে দারিদ্র্যমুক্ত এবং সচ্ছল, তেমনি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থানকে করেছে উন্নত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা ২৪৭৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে, যা এযাবত কালের রেকর্ড। এসময়ে রেমিট্যান্স খাতে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিগত অর্থবছরের করোনাকালীন সময়ে অনেক বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। কিন্তু বর্তমান অর্থবছর ২০২১-২০২২ সালের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি পজিটিভ না হয়ে উল্টো নেগেটিভ হতে শুরু করেছে। চলমান অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ২০ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮৮১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার আর ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছে ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের সময়ের তুলনায় প্রায় ২০% কম আর এটা কিন্তু আমাদের জন্য দুসংবাদ। ব্যাংকিং চ্যানেল অর্থাৎ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স প্রেরিত হয়েছে এটা কিন্তু সেটারই হিসাব। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও বড় অংকের রেমিট্যান্স আসে। হুন্ডির মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসে তা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো বেশি হবে। হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত হলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতো। এ জন্য প্রবাসীরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে সহজে টাকা পাঠাতে পারে, সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বহু আগেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরনে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করতে ২% প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে যে কেউ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে তাকে আরো ২% টাকা বেশি প্রদান করা হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ যদি বিদেশে থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে এক লাখ পাঠায়, তাহলে দেশে তাকে এক লাখ দুই হাজার টাকা প্রদান করা হচ্ছে এবং এটা যে কোনো পরিমাণ টাকার বেলায় প্রযোজ্য। এটা নিঃসন্দেহে সরকারের বড় একটি উদ্যোগ। রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে এবং বিদেশে অনেক এক্সচেঞ্জ হাউজের সাথে রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য চুক্তি করেছে। রেমিট্যান্স প্রেরণের জন্য বর্তমানে বিশে^ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংকও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ রেমিট্যান্স সংগ্রহকারীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে। এসব অবশ্যই মহৎ উদ্যোগ, তবে এসবের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে।
বর্তমানে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছে। আশির দশকের শুরুতে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। প্রথমদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি শুরু হলেও বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা , অস্ট্রেলিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বিশে^র প্রায় সকল দেশেই বাংলাদেশের মানুষ কাজ করছে এবং এটি এখন বিশাল একটি থ্রাস্ট সেক্টরে পরিণত হয়েছে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ এবং তাদের দেখাভাল করার জন্য সরকারের জনশক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রয়েছে এবং তারা বেশ ভালো কাজ করছে। বিশে^র কোন কোন দেশের কোন কোন সেক্টরে কোন সময়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তার আপ টু ডেট খবর নিতে হবে এবং তা জনগণকে জানাতে হবে। সেখানে যাতে বাংলাদেশি লোকেরা চাকরি নিয়ে যেতে পারে, তার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লোকজনকে দক্ষ করার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে বাংলাদেশি লোকজন যাতে সহজে ভিসা পায় এবং কম খরচে বিদেশে যেতে পারে সেই বিষয়ে সরকারের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি লোকেরা বিদেশে গিয়ে কাক্সিক্ষত চাকরিতে যাতে যোগদান করতে পারে সে বিষয়টিও সরকারকে মনিটরিং করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। অথচ, এর জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। এই জনগণকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। তাদের কর্মসংস্থান করতে হবে। প্রতিদিনই লোকজন কর্মসংস্থানের জন্য ছুটছে। অপরদিকে বিশ^বাজারে কর্মসংস্থান দিন দিন বাড়ছে। আর এই কর্মসংস্থান পূরণের মতো জনবল পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই। জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক সন্তান নিতে নারীদের অনিহার কারণে ইউরোপের অনেক দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে অনেক মানুষ নিহত এবং আহত হবার কারণে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অপরদিকে আফ্রিকার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং বিশ্ব শ্রমবাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের বেকার যুবকদের বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। সরকার যদি বিদেশে যাবার জন্য একটি ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে তাহলে সেই লোনের টাকা দিয়ে একজন ব্যক্তি বিদেশ যাবে এবং পরবর্তীতে বিদেশে গিয়ে টাকা আয় করে সেই লোন পরিশোধ করতে পারতো। বিদেশ গমনকারী ব্যক্তিটির দেশে অবস্থানরত নিকট আত্মীয় স্বজন এই লোনের বিপরীতে গ্যারান্টর হবে। সরকার অতি সহজেই এ জন্য একটি স্কিম ঘোষণা করতে পারে। ৫০০০ কোটি টাকার একটি বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। পাশাপাশি বিদেশে গিয়ে এদেশের লোকজন যাতে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে, সে জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাসহ যে দেশে যাবে সেই দেশের ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।