Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প সুরক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বরাবরই বেশি। করোনাকালে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে তিন কোটিরও বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আগের দরিদ্রের সঙ্গে নতুন দরিদ্র যোগ করলে দারিদ্রের সংখ্যা কত দাঁড়াবে, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। করোনাকারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে, বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, বহু মানুষের আয় রোজগার হ্রাস পেয়েছে এবং বহু মানুষের ছোটখাটো কারবার বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন, দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিলোপ হতে বসেছে। মধ্যবিত্ত এখন আর তার অবস্থানে নেই; অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে নেমে যাওয়ায় নিম্নবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে বটে, তবে অনেক নিম্নবিত্ত বিত্তহীন, দরিদ্র এমনকি অনেক দরিদ্র হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। করোনা বিত্তবিবেচনায় সমাজ বিন্যাসকে কীভাবে ভেঙ্গে ফেলেছে, তা এ থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। করোনার প্রকোপ কমায় কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার জোর প্রয়াস চলছে। শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, ছোট কারখানা সচল করার চেষ্টা চলছে পুরোদমে। এক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা-সংকট ও প্রতিবন্ধতা কম নেই। সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কবে নাগাদ অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি ও সুবাতাস ফিরে আসবে, সেটাই প্রশ্ন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাস ও পণ্যের দাম বাড়ায় আমাদের দেশেও তার বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। দেশে তেল-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে অনিবার্যভাবেই পরিবহন ও উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যয়-বৃদ্ধি ঘটেছে। এই বৃদ্ধির প্রভাব শুধু মানুষের ওপরই নয়, অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে। চাপ আগামীতে আরো বাড়বে বা বাড়তে পারে, এমন আশংকা অমূলক নয়। এখনই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ সকল পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় এমনিতেই টান ছিল; সেটা আরো বাড়ছে। পরিবারের চাহিদামতো পণ্য কেনার সামর্থ্য না থাকায় অধিকাংশেরই কম করে পণ্য কিনতে হচ্ছে, থাকতে হচ্ছে কম খেয়ে বা না খেয়ে। এতে স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে; পুষ্টিহীনতা বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এদিকে অর্থনীতির সূচকগুলোও ক্রমাবনতিশীল। রফতানি ও প্রবাসী আয় কমছে, রাজস্ব আয়ও তাই। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায়, উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
জনগণের মসৃণ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত এবং জাতীয় উন্নয়ন দ্রুতায়িত করাই আমাদের অর্থনীতির মূল ক্ষল্য। এজন্য বিনিয়োগ, উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বিনিয়োগে অনেক দিন ধরেই খরা চলছে। দেশ-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই বাড়ছে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। যে কোনো মূল্যে চেষ্টা ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। গার্মেন্ট প্রধান শিল্প হলেও ইতোমধ্যে বহু গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বস্ত্র, পাট, চামড়া ও অন্যান্য শিল্পের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। নানা সমস্যা-সংকটে এসব শিল্প জর্জরিত। গোটা শিল্পখাতের লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মী এখন বেকার। শিল্পের সমস্যা-সংকটের আশু অবসান কাম্য। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যাই বেশি। পণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে এই দুই শিল্পশ্রেণির ভূমিকা অনেক বেশি। দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে, বরাবরই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প শোচনীয় অবহেলার শিকার। ফলে এদের প্রত্যাশিত উন্নতি ও বিকাশ ঘটেনি। করোনার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় সরকার শিল্পক্ষেত্রে যে প্রণোদনা দিয়েছে, তার প্রায় সবই বড় শিল্পের ভাগে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য যা দেয়া হয়েছে, তাকে অনেকটা ‘নামকাওয়াস্তে’ বলা যায়। ব্যাংকগুলো এই সামান্য অর্থও দিতে চায়নি বা দেয়নি। এই টাকাও কারো মেলেনি ঘুষ ছাড়া। প্রায় ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো টাকাই পায়নি। অথচ, ব্যাংকঋণ পরিশোধে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সচ্ছ ও দায়িত্বশীল বলে প্রমাণিত। প্রণোদনার টাকা না পাওয়া এবং সরকারের তরফে বিশেষ কোনো সহযোগিতা না মেলায় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম মালিক সমিতির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাবনা-সিরাজগঞ্জের ছয় লাখ তাঁতের প্রায় চার লাখই বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যত্রও একই অবস্থা। অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবস্থাও একই রকম। ছোটখাটো হোটেল, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বলতে গেলে লাঠে উঠেছে অনেক আগেই। পুঁজি বা অর্থাভাবে এগুলো নতুন করে সচল করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প ও উদ্যোগের বিপর্যয়ে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মী কর্ম হারিয়ে বেকারে পরিণত হয়েছে।

জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের অবদান ২৫ শতাংশ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই এখাতে। কাজেই, এখাতের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে, উদ্যোক্তারা অন্যত্র চলে গেলে এবং শ্রমিক-কর্মীরা বেকার হয়ে পড়লে জিডিপিতে এর অবদানই কমবে না, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও হ্রাস পাবে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, গুটিকয়েক উন্নত অর্থনীতির দেশের কথা বাদ দিলে সবদেশের অর্থনীতিতেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান বেশি। অনেক দেশে এটা অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। সব দেশই প্রয়োজনীয় ও জরুরি পণ্যের প্রাপ্তি ও কর্মসংস্থানের অধিকতর সুবিধায় এই খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে কেন এত অবহেলা, তার কোনো জবাব নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ এবং আগামীর প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দুর্গতি বিনাশে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। চলমান সমস্যাগুলোর দ্রুত সুরাহা করতে হবে। এখাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও অধিকতর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের সুরক্ষা ও বিকাশে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং তাদের দৃঢ় হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প সুরক্ষা
আরও পড়ুন