Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় মূল্যবোধ এখন নির্বাসিত

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

১৭৯৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ বিপ্লবের পেছনে দুটি সামাজিক উপাদান বড় প্রভাব ফেলেছিল। এর মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্র এ সময় নীতিহীনতায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়ে গিয়েছিল। ফলে সমাজে অস্থিরতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সমাজ থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে গিয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে সমাজের মুক্তিকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা নীতিহীনতার বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকা প্রদর্শন করেছিল। মূল্যবোধ উপাদানটি এ সময় ফরাসি সমাজে আপোসহীনতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে ১৭৮৯ সালে সূচিত হওয়া বিপ্লব ১৭৯৯ সালে চূড়ান্তভাবে সংঘটিত হলো। একই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মূল্যবোধের যথেষ্ট চর্চা ছিল। ভারতে বহু ধর্মের লোক এক সমাজে পাশাপাশি বসবাস করতো। তাদের মাঝে একে অপরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ছিল। পাশাপাশি বসবাস করলেও কারো প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। এর মূল কারণ ছিল উন্নত মূল্যবোধ। অতীতে ভারতের ধর্মীয় জীবন ছিল খুবই উন্নত। ধার্মিকরা ছিলেন চরম পরমতসহিষ্ণু ও পরধর্মসহিষ্ণু। ফলে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ হয়ে উঠেছিল অনেক উন্নত। এ সময় বাংলায় মূল্যবোধের অনুশীলন ছিল চোখে পড়ার মতো। সুনীতি, সুশিক্ষা আর সুবিচার ছিল বাংলার শাসন ব্যবস্থার অনন্য শ্রেষ্ঠ উপাদান। সহনশীলতা, উদারতা, মায়া-মমতা আর মানবতা ছিল প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। ফলে পুরো উপমহাদেশ হয়ে উঠেছিল মূল্যবোধের পাঠশালা।

কিন্তু বর্তমানের অবস্থাটা খুবই হতাশাজনক। এখন মূল্যবোধের চর্চা অনেকটাই উপেক্ষিত। বলা হয়ে থাকে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। বর্তমান অবস্থাটা এ প্রবাদের প্রতিচ্ছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভালোটা যেন সমাজ থেকে দিন দিন উঠে যেতে বসেছে। আগের সমাজের মানুষ ধনের চেয়ে সম্মানকে বড় করে দেখতো। মান-সম্মানকে মানুষ বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতো। বর্তমান সমাজটা একবারেই পাল্টে গেছে। সমাজের মানুষ বিরামহীন ছুটে চলছে বিত্তের পেছনে। বিরামহীন ছুটতে গিয়ে তারা জলাঞ্জলি দিচ্ছে তাদের সততা ও নৈতিকতা। জড়িয়ে পড়ছে তারা নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে। এটা এখন শুধু দেশের একটি সেক্টরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ অনৈতিক কর্মকান্ড এখন প্রতিটি সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রভাবশালীদের অনেকে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে রয়েছে। ‘ভবিষ্যতেও অনেককেই জেলে যেতে হবে’ এই ভয়ে বাঁচবার জন্য তারা এখন থেকেই অনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই নীতিহীনতায় নিমজ্জিত। সমাজে এ নীতিহীনতাই মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে পরিচিত। দেশে নীতির চর্চা এখন অনেকটা বোকাদের কাজে বলে মনে করা হচ্ছে। নীতিবান লোককে এখন সমাজে তেমন আর সম্মান করা হয় না। সম্মান এখন টাকা ও অর্থ দ্বারা বিবেচনা করা হয়। অথচ, এ দেশেই এককালে নীতিবান হতদরিদ্র ব্যক্তিকেও সম্মানের চোখে দেখা হতো। এসব নীতিবান ব্যক্তি গুণীজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ সমস্ত গুণীজনকে সমাজের সকলেই সম্মানের চোখে দেখতো। বর্তমানে সেদিন আর অবশিষ্ট নাই। নীতি আর মূল্যবোধ চর্চাকে এখন বিদ্রুপের চোখে দেখা হয়। সমাজ এখন ‘টাকা যার, সম্মান তার’ নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। নীতিবান গুণীজনেরা সমাজে অনেকটা অপাংক্তেয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। সমাজ এখন আর নীতিবান গুণীজনদের কদর করে না। তারা কদর করে সুদখোর টাকাওয়ালা মহাজনদের। এসব টাকাওয়ালা ব্যক্তি এখন সমাজের পরিচালক ও নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে তারা প্রচন্ড প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী আর দেশের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছেন। তাদেরকেই সমাজের লোকজন এখন তৈল মারায় ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। সমাজ এখন এসব প্রভাবশালীকেই সম্মান-তাজীম ও সংবর্ধনা প্রদান করে। সংবর্ধনা সভায় এ নীতিহীন মানুষগুলোর মুখ থেকেই আবার নীতিবাক্য উচ্চারিত হয়!

মুখের উচ্চারণ আর কাগজের মাঝেই দেশের মূল্যবোধ এখন আটকে রয়েছে। প্রভাবশালীদের অনৈতিক শক্তিতে শিকলবন্দি হয়ে পড়েছে দেশের মূল্যবোধ। দেশে মূল্যবোধের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মনুষত্ব সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলবে। নিকট ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম মূল্যবোধকে রূপকথার কল্পকাহিনী হিসেবে খুঁজে ফিরবে। অথচ, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূল্যবোধকে পুঁজি করে। একই বছরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছিল। এ ঘোষণাপত্রটি ছিল মূল্যবোধে উজ্জীবিত এক অসামান্য মূলনীতি। মূল্যবোধের দিক থেকে এ ঘোষণাপত্রটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য এক দলিল। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। ছিল রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার আইনি দলিল। এ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম।’ মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধে রচিত এ বিধান আজ বলতে গেলে দেশের সবক্ষেত্রে উপেক্ষিত। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য এটা একদিকে যেমন দুঃখজনক তেমনি লজ্জাজনকও বটে। কারণ, জারিকৃত উক্ত নীতির ভিত্তিতে আজকের বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে না। মূলত জারিকৃত মূল্যবোধের অনুপস্থিতিটাই হলো আমাদের সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে যখন নৈতিক স্খলন ঘটে, যখন চ্যুতি-বিচ্যুতি ঘটে তখনই তাকে সামাজিক অবক্ষয় বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ আজ নানামুখী অবক্ষয়ে জর্জরিত। বাংলাদেশের সমাজে মাদক এবং ইয়াবার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। গাঁজা ফেনসিডিলের ব্যবসাও রমরমা। মাদকতার স্রোতে দেশের যুবসমাজ আজ ভেসে যেতে বসেছে। দেশের কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি এ ব্যবসার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্টের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ শিশু আছে, যাদেরকে পথশিশু বলা হয়। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ শিশু হিরোইন আসক্ত, ৪০ শতাংশ ধূমপায়ী, ২৮ শতাংশ ট্যাবলেটে আসক্ত এবং ৮ শতাংশ ইনজেকশনে আসক্ত। এটা জাতি-রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক এক অশুভ ইংগিত। এটা মানবিক মূল্যবোধের চরমতম অবক্ষয়। দেশে বন্যার পানির মতো পর্নোগ্রাফির আসক্তি বেড়ে গেছে। তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা পর্নোগ্রাফির ভয়াল নেশায় মত্ত। আর শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝেই এ নেশা সীমিত নয়। মধ্যবয়সি নারী-পুরুষও এ মরণ নেশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শতকরা ৮০ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। ফলে পর্নোগ্রাফি আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অপরিণত ও অসংগতিপূর্ণ যৌনাচার সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। আর এসব অবক্ষয়ের সাথে জড়িত অধিকাংশই শিক্ষিত জনশক্তির অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখিত অবক্ষয়সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। এ অবক্ষয়ের ব্যাপ্তি সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। ফলে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে সততা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিয়েছে। তারা ধৈর্য, উদারতা ও শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলেছে। কর্মে তাদের নান্দনিকতা, নিয়মানুবর্তীতা ও সৃজনশীলতা লোপ পেয়েছে। তারা তাদের অধ্যাবসায়, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ ও দায়িত্ববোধ প্রভৃতি নৈতিক গুণাবলী নষ্ট করে ফেলেছে। সামগ্রিক জটিলতার কারণে মানবিকমূল্যবোধের জায়গায় স্থান পেয়েছে সামাজিক অবক্ষয়। দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবক্ষয়ের এখন জয়-জয়কার অবস্থা। দেশের ব্যাংক ব্যবসায় দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি দেশের মূল্যবোধের বড় অবক্ষয়ের নির্দেশক। শেয়ারমার্কেট, ডেসটিনি, যুবক আর হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনা নৈতিক মূল্যবোধ বিচ্যুতির নির্দেশ প্রদান করে। দেশে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও চুরির ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকাতি, ছিনতাই, গুম ও খুন এখন স্বাভাবিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাস, রাহাজানি ও নৈরাজ্য সামাজিক অবক্ষয় বিস্তৃতির এক মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ। এসব অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে পারস্পারিক অসহিষ্ণুতা, সর্বগ্রাসী অশ্লীলতা এবং মাদকতা। পাশাপাশি রয়েছে ধর্মবিমুখতা। অথচ, যুগযুগ ধরে ধর্মই মানুষকে ভদ্র করে গড়ে তুলেছে। ধর্মের সঠিক অনুশীলন ও শিক্ষা মানুষকে রুচিশীল ও সাংস্কৃতিবান করেছে। ধর্ম ধার্মিকদের করেছে ভদ্র ও মার্জিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমনের সময়কালে আরবের প্রায় সকল মানুষ ছিল বর্বর আর নিকৃষ্ট। ছিল তারা অভদ্র, নির্দয়, নিষ্ঠুর আর অত্যাচারী। অথচ, ধর্মের সঠিক শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে সেই তারাই বিশ্বসেরা ভালো মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। ধর্মের যথাযথ অনুশীলন তাদের তৎকালীন বিশ্বসেরা গুণীজন হিসেবে ভূষিত করেছিল। গুণীজন হিসেবে তারা শুধু পৃথিবীতেই সেরা মানুষ ছিলেন না, বরং পরকালের জন্য নির্বাচিত সেরা মানুষের স্বীকৃতিটাও এ পৃথিবী থেকে পেয়ে গিয়েছিলেন। ‘আল্লাহ তাদের (সাহাবিদের) উপর খুশি আর তারাও আল্লাহর প্রতি খুশি’ (সুরা বাইয়্যেনাহ: ৮)। পবিত্র হাদীস শরীফে এসেছে: ‘আবুবকর, উমার, আলী, উসমান, তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ, সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস, সাঈদ ইবনু জায়েদ ও আবু ওবায়দা ইবনু যাররাহ (রা.)-এ দশজন সাহাবী দুনিয়া থেকে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে গেছেন’ (মুসনাদে আহমাদ: ১৫৬৫)। ইসলাম ধর্ম মতে, এরকম মূল্যবোধে সিক্ত মানুষ আর পৃথিবীতে আসবে না। বিশ্বের সকল ইতিহাস এটাই জানান দেয় যে, পৃথিবীর সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে কেন্দ্র করে। তাই মূল্যবোধে সিক্ত একটি সমাজ গড়তে প্রয়োজন ধর্মের ব্যাপক শিক্ষা ও তার যথার্থ অনুশীলন। প্রয়োজন ধর্ম লালন ও তার সম্প্রসারণ। ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব (র.) তাই বলেছেন, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে তাকে সভ্য সমাজ বলে’।

আধুনিক যুগ একটি পরিবর্তনের যুগ। দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেছে সৌরজগতের এ ছোট পৃথিবীটি। আর যেটুকু আছে সেটুকুও ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিবর্তন অপেক্ষা করছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষও পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। তারা হয়ে যাচ্ছে বড্ড অচেনা। ইতিমধ্যে দেশীয় বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অবকাঠামোগত নানা দিকেরও পরিবর্তন সাধিত হতে চলেছে। আর মানব-জীবনের সবচেয়ে বড় দিক হলো মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন। ন্যায় এবং অন্যায় বিভাজনে মানুষ এখন বড়ই দ্বিধান্বিত। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলাটা বড়ই দুষ্কর। দেশে কোনটা আলো আর কোনটা অন্ধকার সেটার পার্থক্য করাও বড় কষ্টকর। সততার আলো যেন মানুষের চক্ষুকে এখন ঝলসে দিচ্ছে। মানুষ যেন বুনো বাদরে পরিণত হয়ে গেছে। পরিণত হয়ে পড়েছে তারা পেঁচায়। দিনের আলো যেন মানুষের এখন ভালো লাগে না। রাতের অন্ধকার তাদের বড়ই প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ, তারা দিনের চেয়ে রাতকেই বেশি ভালোবাসে। অসৎ মানুষেরা রাতটাকে এখন বাদুড়ের মতো আরামদায়ক করে নিয়েছে।

সমাজের কতক লোক আবার সততার ছদ্মাবরণে আচ্ছাদিত। বাহ্যিকভাবে তারা ভালো মানুষের রূপ ধারণ করতে বেশ অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন ধর্মীয় লেবাস। এসব লেবাসধারীদের অন্তরটা শত জটিল, কুটিল আর নানা অসততায় পরিপূর্ণ। কোনো কারণে যে কোনো বিষয়ে তাদের সাথে মতের অমিল হলেই তাদের খোলস বেরিয়ে পড়ে। তাদের লেবাসের অন্তরালে জমানো ঘৃণ্য চরিত্র উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের অন্তরে লালিত আসল চেহারা মুখের ভাষায় প্রকাশ পেতে থাকে। লেবাসের আড়ালে মূলত তাদের অনৈতিকতা, অসাধুতা আর চরম নির্লজ্জতাই জাহির হয়ে পড়ে। সরকারি অফিসের অনেক ঘুষখোর আছেন যাদের মুখ দাঁড়িতে ভরা। পরনে থাকে তাদের ধর্মীয় পোশাক। আর মাথা থাকে টুপিতে ঢাকা। এই ঘুষের টাকা দিয়েই আবার তারা হজ্জে যান। এসব মন্দ লোকের বাইরের আবরণটা বেশ চুপচাপ ও ভদ্রতায় ভরা। কিন্তু তাদের ভিতরটা ভয়ঙ্কর নেকড়ে মানসিকতায় পূর্ণ। সুযোগ পেলেই তারা হিংস্র হয়ে উঠে। এটাই হলো বর্তমানের সমাজচিত্র। এ চিত্র প্রতিদিনই মানুষের আত্মাকে একটু একটু করে কলুষিত করে চলেছে। অর্থ আর স্বার্থ ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিবেশ মূল্যায়ন করে এভাবে বলা যায় যে, নৈতিকতার যদি কোনো কাঠামো ও অবয়ব থাকতো, তাহলে এতদিনে তাকে গুম করা হতো কিংবা গভীর জঙ্গলে নির্বাসন দেয়া হতো অথবা নদীতে ডুবিয়ে চিরতরের জন্য সলিল সমাধির ব্যবস্থা করা হতো। আমরা ঘোরময় মূল্যবোধশূন্য এক অন্ধকার অমানিশাতে বসবাস করছি।


লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

Show all comments
  • Saifur Rahman Ashrafi ২১ নভেম্বর, ২০২১, ৯:৩৮ এএম says : 0
    আলহামদুলিল্লাহ। স্যার, সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে
    Total Reply(0) Reply
  • জে,এম, মুহিব্বুল্লাহ মুহিব ২১ নভেম্বর, ২০২১, ৯:৪৯ এএম says : 0
    অসম্ভব তথ্যবহুল লেখা,প্রিয় স্যারের প্রতি আরো অনেক অনেক শ্রদ্ধা বেড়ে গেল,,,,,,, দীর্ঘজীবি হোন প্রিয় অভিভাবক।
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৩৮ এএম says : 0
    আমাদের দেশটা তাগুত সরকার একদম ধ্বংস করে ফেলেছে আমরা মুসলিম বলে দাবি করে অথচ আমাদের দেশে চলে কাফেরের আইন দিয়ে আজকে আমাদের দেশে ইসলামের বিপ্লব ঘটাতে হবে তাহলে আমরা আবার সাহাবাদের মতো জীবন যাপন করতে পারব
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৫৫ এএম says : 0
    আল্লাহ তায়াল বলেন, ‘তার পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের আগে এবং পেছনে, আল্লাহর নির্দেশে তারা ওদের হেফাজত করে। আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ওই পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোনো জাতির ওপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা রাদ : ১১)
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৫৭ এএম says : 0
    বিশাল এই মহাবিশে^র নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র আল্লাহ। তিনি এ কাজে অসংখ্যা ফেরেশতা নিয়োজিত রেখেছেন। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের সামনে-পেছনে সর্বত্র অনুসরণ করছে। মানুষ যখন যা কিছু করে বা ভাবে তারা সবই সংরক্ষণ করছে। পরকালে সে সব সামনে আনা হবে এবং সে অনুযায়ী বিচার হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভাগ্য ও অবস্থা ওই পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ মানুষ নিজেকে নিজে পরিবর্তন না করে। পৃথিবীতে মানুষকে স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা কেউ ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারে, খারাপ কাজেও ব্যবহার করতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে পরিবর্তন করবে, তখন আল্লাহও তার অবস্থা পরিবর্তন করবেন। অনুরূপভাবে যখন কোনো জাতি নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করবে তখন আল্লাহ তায়ালাও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন। আল্লাহ যখন কোনো ব্যক্তি বা জাতির ওপর আজাব অবতীর্ণ করতে চান তখন কেউ তা রদ করার ক্ষমতা রাখে না। মানুষের কর্তব্য হচ্ছেÑ বিপদ আসার আগেই সংশোধিত হওয়া। তবু বিপদ চলে এলে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা।
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০০ পিএম says : 0
    মহান আল্লাহ আরো বলেন [Surah: Az-Zukhruf:4: Ayat:] “আপনি কি বধিরকে শোনাতে পারবেন??? অথবা যে অন্ধ ও যে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত তাকে পথ প্রদর্শন করতে পারবেন????...” ? দৈহিক, জৈবিক তাড়না, বৈশিষ্ট্য ও স্বাভাবিকতায় মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রভেদ হলো: ইতর প্রাণীর যোগ্যতা প্রকৃতিগত, অন্যদিকে মানুষ তার যোগ্যতার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। “মানবতা ও নৈতিকতাহীন মানুষ চেহারায় মানুষ হলেও প্রকৃতিগত মানুষ নয়”।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় মূল্যবোধ
আরও পড়ুন