Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

বরিশালের গৌরনদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মেয়ে চুমকি। চুমকির বয়স যখন আট, তখন তার বাবা দীর্ঘদিনের কঠিন রোগে কষ্ট পেয়ে মারা যায়। চাচারা ষড়যন্ত্র করে ঋণের অজুহাত দেখিয়ে বসত ভিটা দখল করে চুমকিদের ঘর থেকে বের করে দেয়। গ্রাম্য বিচারে রায় গেলো চাচাদের পক্ষে। অগত্যা আর কী করা! জন্মস্থান, সবুজে ঘেরা গ্রাম ছাড়লো চুমকিরা, ক্ষোভে, অভিমানে। বেঁচে থাকার তাগিদে এক অগ্রহায়ণে ঢাকা চলে এলো। এসে আশ্রয় নিল রেলওয়ের এক বস্তিতে। এখানে তাদের গ্রামের বাড়ির লোক ফরিদ থাকে। সে ভাড়ায় টেক্সি চালায়। ফরিদের সহযোগিতায় চুমকির মা কাজ পায় নীলক্ষেত এলাকায় একটি চা-এর দোকানে। তার কাজ ধোয়া-মোছা ও মরিচ-মসল্লা বাটা। মায়ের সামান্য আয়ে চুমকিসহ অন্য ছোট দুই ভাইয়ের দুই বেলা ভাত খাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাস শেষে ২৫০ টাকা ঘর ভাড়া দিতেও হিমশিম খেতে হয় চুমকির মাকে।

চুমকি এক প্রকার বাধ্য হয়েই মায়ের দেয়া ১২০ টাকা পুঁজি নিয়ে কাটা ফলমূল ব্যবসায় নেমে পড়ে। সারাদিন নগরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ায়, ফেরি করে। মৌসুমী ফল খিরা, শশা, গাজর, বেল এবং আমড়া যা পায় তা-ই চুমকি ফেরি করে। চুমকির সাথে কথা হলে সে অসহায় কণ্ঠে জানায় তার জীবনের ঘটনাবলী।

সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ৫০/৬০ টাকা লাভ হয় চুমকির। কিন্তু ফেরি করতে গিয়ে প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। বিশেষ করে পলাশী এলাকা, রেল স্টেশন এবং বাসস্ট্যান্ডগুলোতে চুমকি অসুবিধায় পড়ে যায়। এ সমস্ত এলাকায় বেঁচা-বিক্রি ভালো হয় বলে ঐ সমস্ত এলাকায় না গিয়েও পারে না। পলাশী এলাকাতে ভবঘুরেরা, রেল স্টেশনের কুলি-মজুররা এবং বাসস্ট্যান্ডে বাসের হেলপাররা খরিদ করার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে চুমকির গায়ে হাত চালাতে চেষ্টা করে। এতে চুমকির মন খারাপ হয়ে যায়। একদিন প্রতিবাদ করেছিলো চুমকি এক মাঝবয়সী লোকের কুপ্রস্তাবে। উপস্থিত ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ঐ লোকটাকে অন্যরা ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়ে, কান ধরে উঠ-বস করিয়ে পুলিশে দেবে ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো।

চুমকি ভাবে, ফেরি ব্যবসা ছেড়ে দেবে। পরক্ষণে মায়ের হাড়ভাঙ্গুনি কষ্ট, ছোট দুই ভাইয়ের ক্ষুধার্ত মুখগুলো মনে পড়ায় আবার রাস্তায় নেমে পড়ে। বাসাবাড়িতে কাজের চেষ্টা করেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু প্রায় বাসার কত্রীর মন্তব্য একটাই, জিম্মাদার কে হবে, যদি কিছু চুরি করে পালিয়ে যায়, কে নেবে তার দায়ভার?

একটি শিশুর জীবন শুরু হয় খুবই ধীরগতিতে। জীবনের অনাগত দিনের দিকে এগিয়ে যায় ক্রমাগতভাবে। তাকে ডাকে ভবিষ্যতের স্বপ্নভরা দিনগুলো। কিন্তু সব শিশুর কি দিনগুলো মসৃণ হয়? হয় না। যেমন হয়নি চুমকির। হাজারো চুমকি এদেশে রয়েছে যারা পথে ঘাটে নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে মানুষ নামের এক ধরনের পশুদের হাতে। যখন পর্যন্ত আমরা নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগ্রত করতে পারবো না ততক্ষণ পর্যন্ত অসহায় শিশুদের জন্য কিছু একটা করাও হবে না।

সমাজে প্রায়ই শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতন হচ্ছে বাসা-বাড়িতে, প্রতিষ্ঠানে, আত্মীয়ের বাড়িতে, দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের হাতে অথবা গৃহ শিক্ষক বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হাতে। দেখা যায়, নির্যাতনকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে দৈহিক আঘাত না করে কৌশল অবলম্বনে মানসিক চাপ সৃষ্টি, ভয় প্রদর্শন, গিফট দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে নিপূণভাবে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়।

আমরা একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবো, দেশের প্রতিটি শহর অঞ্চলে অভিভাবকহীন ও অসহায় পথশিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাসস পরিবেশিত এক খবরে জানা যায়, ৬টি বিভাগীয় শহরে বর্তমানে প্রায় ৫ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই মোট পথ শিশুর ৭৫ ভাগ বাস করে। এইডস প্রতিরোধ কমিটি, শিশু অধিকার ফোরাম, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কমিটি এবং বিজ্ঞমহলের মতে, যে হারে পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছে এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরিভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশের জন্য এটি পাহাড়সম সমস্যায় পরিণত হবে।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করে যে, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি সকল শিশুর অবিচ্ছদ্য মানবাধিকার রক্ষা এবং প্রতিবেদন তৈরি করবে। ১৯৮৯ সালের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত সনদ সবকটি রাষ্ট্র অনুমোদন করেছে। শিশুরা যাতে মৌলিক ৫টি অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, নিরাপত্তা ও সহায়তা পেয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সনদ অনুমোদনকারী রাষ্ট্রগুলো সে ব্যাপারে একমতে উপনীত হয়েছে। ইউএনসিআরসিতে স্বাক্ষর করে রাষ্ট্রগুলো বৈষম্য, যৌন ও বাণিজ্যিক শোষণ এবং সন্ত্রাস থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকার করেছে। এতিম ও অসহায় শিশুর দেখভালের দায়িত্ব নিতে সকলে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। শিশুশ্রম এবং যৌনকর্ম বন্ধ করতে ১৫০টি দেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সমঝোতা স্মারক ১৮২-এর অনুমোদন দেয়। তারপরও সংবাদপত্রগুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে সেজন্যে জাতি উদ্বিগ্ন। দিন দিন মানুষের চরিত্রের অবক্ষয় ঘটছে। অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দুই একটা মাঝে মধ্যে হলেও অনেক ঘটনা নিরবে অতলে তলিয়ে দিচ্ছে এক শ্রেণির দুষ্টচক্র। আমাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন করতে হবে। মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা আরো জোরদার করতে হবে।

ইউএনডিপি’র অর্থায়নে পরিচালিত সমাজসেবা অধিদফতরের অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রিসোর্সেস ফর ইমপপ্রুভিং স্ট্রিট চিলড্রেন এনভায়রনমেন্ট (এরাইজ) প্রকল্পে দেশের ৬টি বিভাগের সার্ভে প্রতিবেদন অনুযায়ী পথ শিশুর শতকরা ৪.৮৫ জনকে জোরপূর্বক যৌনকর্মে এবং শতকরা ২ জনকে সমকামিতায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শতকরা ২-৩ জনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ধরনের নানাবিধ কারণে শতকরা ৯ থেকে ১৫ বছরের পথ শিশুর শতকরা প্রায় ২ জন বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ্য যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, শতকরা হিসেবে ৮৪ জন পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে মমতাময়ী মায়ের কোল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। ঘর-বাড়ি কী জিনিস তা তাদের অনুভূতি থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে থাকে। পথশিশুর ৪৯ ভাগ বালিকা এবং ৫১ ভাগ বালক। শতকরা ২ জন শিশু বাড়িঘরহীন বা আশ্রয়হীনভাবে এ নশ্বর পৃথিবীতে জন্মলাভ করছে। নদী ভাঙনের কারণে শতকরা ২ জন, খাদ্য সংকটের কারণে শতকরা ০.০৪ জন, ভূমিগ্রহণের ফলে শতকরা ০.২৬ জন, ভূমিহীনতার কারণে শতকরা ৪ জন, বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণে ০.১৬ জন এবং অনির্দিষ্ট কারণে শতকরা ০.৪৮ জন নিষ্পাপ শিশুকে পথশিশুতে পরিণত করছে বলে সূত্রে জানা গেছে।

রাজধানীর ঢাকার ইউনিসেফেরে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড এডুকেশন বিভাগের কর্মকর্তারা অভিমত প্রকাশ করেছে যে, পথশিশুরা কোনো অধিকারই ভোগ করতে পারছে না। অতি বাস্তব সত্য কথা হলো, এ দেশে শত চেষ্টা করেও শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। ইউনিসেফ সাড়ে তিন লাখ শিশুকে আর্ন-এন্ড-লার্ন প্রকল্পে এনেছে। সুখের খবর হলো যে, এরা কাজের পাশাপাশি ২ বছর পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমান নির্ধারিত ২ বছর সময়কে বাড়িয়ে ৫ বছর করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তাদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে।

শিশুর অবস্থার উন্নয়নে এবং শিশুর অধিকার সুসংহত করতে হলে প্রয়োজন শিশু অধিকার বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শিশুর প্রতি আন্তরিক মনোভাব পোষণ করা। সরকার শিশুর স্বার্থ রক্ষাকল্পে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৪ সালে শিশুদের জন্য জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করেছে। এ নীতির আলোকে শিশু উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য তথ্যে জানা যায়, সারাদেশে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইউনিসেফ ও অন্যান্য এনজিও সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে শিশুর শারীরিক, মানসিক সুস্থতা ও সঠিক সময়ে বিকাশের জন্য শিক্ষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দরিদ্র ও পথ শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য এবং তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতাবোধ জাগ্রত হবার জন্য সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নগদ অর্থ প্রদান হলো এ পরিকল্পনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কোনো শিশু যেনো বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সরকারী তরফ থেকে।
সরকারি এক সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রণীত শিশু আইনে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে সুস্পষ্ট বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে সুস্পষ্টভাবে যা উল্লেখ আছে তা হলো, যদি কোনো ব্যক্তি তার অধীনে শিশুকে আক্রমণ করে, নির্যাতন চালায়, অবহেলা করে, যৌন বিষয়ে আকৃষ্ট করতে চায় তাহলে ঐ ব্যক্তির দুই বছরের কারাদন্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আজকের শিশুদের তৈরি করতে হবে অনাগত দিনের জন্য। তাই যাতে কোনো একটি শিশু কখনোই কোনো নির্যাতনের শিকার না হয়, মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে সরে না যায় সে ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ থাকতে হবে এবং দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে, সে আইন বাস্তবায়নে আমরা সচেষ্ট নই। যারা আইনের রক্ষক তারা কেনো জানি অনীহ। নারী নির্যাতন এবং শিশু নির্যাতন ও শিশুশ্রম এ তিন বিষয়ে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। শিশুর যত্ন-আর্ত্মি, নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা এবং শিশু শ্রম বন্ধে কঠোর আইনের ব্যবস্থা থাকলেও এক শ্রেণীর মানুষ এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট আইনের ধারা প্রণয়ন করা, সরকার তা-ই করেছে। ঐ নির্দিষ্ট আইন প্রয়োগে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। জনগণের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশুদের অধিকার
আরও পড়ুন