পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ফলে আমাদের দেশে আবাদি জমি ও মৎস্য চাষের জায়গা দিনদিন কমে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য তাই সীমিত জায়গার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষ অল্প জায়গায় বেশি মাছ উৎপাদন উপহার দিতে পারে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের বহুল আলোচিত পদ্ধতি হল বায়োফ্লক। সারাবিশ্বে খাদ্যের অন্যতম উৎস হলো মাছ। মাছ আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাহিদাও পূরণ করতে পারে। সমগ্র বিশ্বে মাছের চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মাছ চাষের ব্যবস্থা। পুরানো পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে অনেক মৎস চাষি লোকসানের সম্মুখীন হয়, তাই মাছ চাষের খরচ কমানোর জন্য এসেছে নতুন ধারার অনেক প্রযুক্তি। এদের মধ্যে বায়োফ্লক পদ্ধিতিতে মাছ চাষ অন্যতম। আয়তনে ছোট আমাদের বাংলাদেশে মাছ চাষের জন্য খুবই উপকারী। পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে অনেকে মাছ চাষ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ একটি উৎকৃষ্ট সমাধান। কারণ, এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের খুবই অল্প জায়গা প্রয়োজন। বায়ো শব্দের অর্থ জীবন আর ফ্লক শব্দের অর্থ আলতোভাবে লেগে থাকা কণা সমষ্টি। বায়োফ্লক হলো উপকারী ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবাল দিয়ে গঠিত পাতলা আস্তরণ, যা পানিকে ফিল্টার করে এবং পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নিয়ে অধিক প্রোটিন যুক্ত খাবার (ফ্লক) তৈরি করে। উৎপাদিত এই অধিক প্রোটিন যুক্ত খাবার মাছ গ্রহণ করে দ্রত বেড়ে উঠে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের জৈব বর্জ্য হতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি হয়। বায়োফ্লক প্রযুক্তির সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য, মল-মূত্র থেকে অণুজীব প্রোটিন (ফ্লক) তৈরি করে ফলে কম খাদ্য সরবরাহ করলেও হয়। তাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ লাভজনক টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। এই পদ্ধতিতে ৩০% পর্যন্ত মাছের খাবার সাশ্রয় হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রকার মাছ করা যায়। যার মধ্যে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তেলাপিয়া, শিং, পাবদা, গুলশা, রুই মাছ চাষ শুরু হয়েছে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো, এটি অল্প জায়গায় করা যায় এবং বেশি পরিমাণ মাছ উৎপাদন করা যায়। খাদ্যের পুনর্ব্যবহার হয় বলে খাবারের অপচয় অনেক কম হয়। প্রাকৃতিক ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করা হয় বলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে, ফলে খামারকে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করা যায়। প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারী ব্যাক্টেরিয়া প্রয়োগ করা হয় বলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ খুবই পরিবেশ বান্ধব। পুকুরের সমান পরিমাণ জায়গায় কম সময়ে বায়োফ্লক ২০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন করা যায়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে যা লাগবে: চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, ট্রিপল আউটলেট, টিডিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়া টেস্ট কিট, ডিও মিটার, অক্সিজেন মটর (এরেটর), থারর্মোমিটার, বিদ্যুৎ, প্রবায়োটিক (প্রাকৃতিক ব্যাক্টেরিয়া), চিটাগুড়, সুষম খাদ্য, মাছের পোনা। সামান্য কারিগরী শিক্ষা নিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করা যায়। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য ৫০০০ লিটার, ১০০০০ লিটার বা প্রয়োজন অনুযায়ী এর হাউজ বা ট্যাংক নির্মাণ করতে হয়। ট্যাংক নির্মাণে কংক্রীট (অধিক ব্যয়) বা লোহার বেষ্টনীর মধ্যে পানিরোধী মোটা পর্দা ব্যবহার করা যায়। গভীর নলকূপের পানি বা নদী জলাশয়ের বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ট্যাংক মাত্রানুযায়ী পূর্ণ করতে হবে এবং ফ্লক তৈরির জন্য প্রথমে ৫ পি.পি.এম প্রবায়োটিক, ৫০ পি.পি.এম চিটাগুড়, ৫পি.পি.এম ইস্ট, টন প্রতি ১ লিটার পানি একটি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮-১০ ঘণ্টা কালচার করে রাখতে হবে। উক্ত কালচারটি ১০০০ কেজি পানিতে প্রয়োগ করতে হবে যদি ১০০০০ লিটার পানি হয় তবে উক্ত পরিমাণটি ১০ গুণ করে দিতে হবে। পানিতে ফ্লক তৈরি হলে পানির রং সবুজ বা বাদামি দেখাবে ও পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখা যাবে। ফ্লক তৈরির পর হাউজ বা ট্যাংকে মাছের পোনা ছাড়তে হয় এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ নিশ্চিত করে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। নিয়মিত ডি.ও, টি.ডি.এস, অ্যামোনিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে এবং যথাযথ ফ্লক তৈরি হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। ১০০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতার একটি হাউজ বা ট্যাংক হতে ৮০০ থেকে ১০০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় ১০০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতার একটি চৌবাচ্চা বা ট্যাংক নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ স্থাপন করতে মোটামুটি ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকার প্রয়োজন (ট্যাংক বা হাউজের ধরন অনুযায়ী খরচের পরিবর্তন হতে পারে)। প্রতি তিন থেকে চার মাস অন্তর অন্তর ১০০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতার ট্যাংক হতে প্রায় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করা যায়। মাছ বিক্রির পর ট্যাংক বা হাউজে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ১৫ দিন পর পুনরায় মাছ ছাড়া যায়। প্রথমবার লাভের পরিমাণ কম হলেও পরবর্তীতে যন্ত্রাংশ বাবদ খরচ কম হওয়ায় লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বেকারত্ব সমস্যা আমাদের দেশের একটি প্রধান সমস্যা। শুধু দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নয়। দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে শিক্ষার হার ও মান বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যাও। এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট এন্ড সোস্যাল আউটলুক ২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলা হয়, এশিয়া শীর্ষ বেকারত্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আত্মকর্মসংস্থানের চেয়ে ভালো চাকরিকে প্রাধান্য দেওয়াই হলো এদেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অথচ, আত্মকর্মসংস্থান যেকোন দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন উপায়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, সেক্ষেত্রে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ আত্মকর্মসংস্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে উদ্যোগী হলে দেশে বেকারত্ব কমে আসবে। মাছের চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে। করোনা পরবর্তী সময়ে শ্রম বাজার ও কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে তাই দেশে যুব সমাজ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতে পারবে এবং টেকসই উন্নয়নে আবদান রাখতে পারবে। আমাদের দেশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ খুব বেশি জনপ্রিয়তা না পেলেও এটির রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।