পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একলাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগে দাম বাড়ানোর সময় লোকদেখানো হলেও গণশুনানির আয়োজন করা হতো। এবার তাও করার সময় হয়নি। জনগণকে জানানো কর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয়নি। তাদের উপেক্ষা করার এটা একটা উল্লেখযোগ্য নজির। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এই দাম বাড়ানোর ঘোষণার পরপরই গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, ধর্মঘটে নেমে গেছে। তারাও জনগণকে এ বিষয়ে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। জনগণের মূল্যমান সরকারের কাছেই যখন নেই, তখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে থাকবে কীভাবে! যে কোনো দাবিতে ধর্মঘটে যেতে হলে স্বীকৃত কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। সুনির্দিষ্টভাবে দাবি জানাতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর দাবি মেনে নেয়ার সময়সীমা জানানো, আলোচনা করা ইত্যাদির পর দাবি অর্জিত না হলে আলটিমেটাম দেয়া এবং সে সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে ধর্মঘটের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া যায়। এসবের কিছুই না করে হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘটে যাওয়া বেপরোয়া মনোভাবের পরিচায়ক। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এভাবে সরকার ও জনগণকে বেতোয়াক্কা করার সাহস কোথা থেকে পায়? সরকার তাদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অথচ, নিতে পারতো। বিরোধীদল মিটিং-মিছিল- সমাবেশ তো দূরে কথা, মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারে না। পুলিশ অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবকিছু ভেঙ্গে দেয়, লাঠিপেটা করে এবং অনেককে গ্রেফতারও করে। বিস্ময়কর, এই অন্যায়-অন্যায্য ধর্মঘটের বিরুদ্ধে সরকার কিছুই করার তাকিদ অনুভব করেনি। মন্ত্রীদের কেউ কেউ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে কথা বলেছেন। ধর্মঘটের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কেবল ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন জনদুর্ভোগের উল্লেখ করে। ধর্মঘটী মালিক-শ্রমিকদের জনদুর্ভোগের ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাদের লক্ষ্য পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি। গত শনিবার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বৈঠক হলেও তা সফল হয়নি। মালিকদের তরফে বলা হয়েছে, ধর্মঘট চলবে। বলা বাহুল্য, আজ হোক, কাল হোক ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত এই ধর্মঘটে দেশের ও দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হবে না। জনদুর্ভোগ যেরকম অকথ্য পর্যায়ে পৌঁছালো তার কথা অনেক দিন মনে থাকবে।
কোনো একটা কিছু হলেই আমাদের দেশে জনগণকে জিম্মি করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় পরিবহনখাতে। তুচ্ছ ও সাধারণ ঘটনা উপলক্ষেও পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘটে যেতে দেখা যায়। এজন্য কারো আইনের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। হয় না বলেই তাদের সাহস বহুদূর বেড়ে গেছে। এবারের ধর্মঘট তার প্রমাণ বহন করে। তাদের ধর্মঘটের দেখাদেখি লঞ্চ মালিকরাও অঘোষিতভাবে ধর্মঘটে গেছে। ফলে নৌপথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনও বন্ধ রয়েছে। এই তিন-চার দিন গণপরিবহন ও লঞ্চ বন্ধ থাকায় জনসাধারণের কী ধরনের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এ সময় পণ্যপরিবহন বন্ধ থাকায় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের শত কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। সমুদ্র বন্দরে কন্টেইনার জট এবং স্থলবন্দরগুলোতে ট্রাকের জট তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছে। মালিক-শ্রমিকেরা কী চায়, প্রথমে কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও, এখন তা পরিষ্কার। তাদের কেউ কেউ জ্বালানির মূল্য কমানোর এবং কেউ কেউ ভাড়া বাড়ানোর দাবি করেছিল। এখন আর মূল্য কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে না। এখন কেবলই ভাড়াবৃদ্ধি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে পরিবহনে ভাড়া বাড়বে, এটা স্বাভাবিক কথা। কিন্তু কতটা বাড়বে সেটাই প্রশ্ন। এ নিয়ে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে সরকারি মহলের আগেই কথা বলা উচিৎ ছিল। অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গণ ও মালামাল পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবে সে ভাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি। জনগণ তো স্বতর্স্ফূতভাবে ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘটে যেতে পারে না, কাজেই তাদের দুর্বহ হলেও মূল্য ও ভাড়া বৃদ্ধির বোঝা বহন করতে হয়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কোথায় কোথায় পড়তে পারে, ইতোমধ্যেই তা বিভিন্ন মহল থেকে ব্যক্ত করা হয়েছে। আসলে এর প্রভাব সর্বত্র পড়বে। কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎসহ যাবতীয় উৎপাদন কার্যক্রম ও জীবনযাপনের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। কৃষি ও শিল্প-উৎপাদনের খরচ বাড়বে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পণ্যমূল্য বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে। আর এই সব বাড়তি ব্যয় বহন করতে হবে জনগণকে। নিরূপায় হলেও তাদের বইতে হবে। এমনিতেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। করোনামহামারির প্রায় দু’বছরে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। জনগণের প্রায় অর্ধাংশ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। কারোনাকালেই তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছে। অনেকে বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছে। অনেকের বেতন কমেছে। অনেকে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় নিত্যপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে এইসব অসহায় ও বিড়ম্বিত মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সরকারিমহলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে। অচিরেই হয়তো ঘোষণা আসবে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম এত শতাংশ বাড়ানো হলো। এটা যে জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া, সেটা না বোঝার কিছু নেই। প্রশ্ন হলো, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের কতটা লাভ হবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, সামান্যই। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি হবে অনেক অনেক গুণ বেশি। জনগণের জীবনমান, আর্থিক সামর্থ্য ও ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। অনেকের মত, সরকারের ব্যবসা করা উচিৎ নয়। সরকারের কাজ জনগণের সুখ-সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য দেখা। যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল, তখন সরকার দাম কমায়নি। এখন বেড়েছে বা বাড়ছে বলে দাম বাড়াবে কেন? দাম না বাড়িয়ে জনগণসহ কৃষি-শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেয়া যেতো। এর সুফল অনেক বেশি হতো। আমরা আশা করতে চাই, সবদিক বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।