পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসলামিক ফাউন্ডেশন জুমার খুতবা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। খবরে প্রকাশ, দেশের সব মসজিদের খতিব ও জুমার খুতবা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখার জন্য জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, মসজিদগুলোকে যাতে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা না হয় সে জন্যই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের মতে, কোনো কোনো মসজিদে জুমার নামাজের খুতবার সময় বাংলা বক্তব্যে এমন অনেক রাজনৈতিক বিষয়ের অবতারণা করা হয় যা পরোক্ষভাবে জঙ্গি কার্যক্রমকে উসকে দিতে পারে। এটা বন্ধ করতে এবং খুতবায় আরবীতে দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে বাংলায় দেয়া বক্তব্যের মিল নিশ্চিত করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বাংলাসহ কিছু গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল। তিনি বলেছেন, বাংলায় বক্তব্য প্রদানকালে অনেক সময় রাজনৈতিক বক্তব্য টানা হয়। খতিবরা বাংলায় যে ওয়াজ করেন, সেখানে যেন তারা আরবী খুতবার সারমর্মটি বলেন। সেখানে কোরআন-হাদিসের পরিপন্থী অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের কথাবার্তা যেন তারা না বলেন। এ ব্যাপারে খতিবদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এর মধ্যেই একটি খতিব কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগ, নির্দেশনা ও মহাপরিচালকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, ৯২ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে জুমার খুতবায় কি বলা যাবে কি বলা যাবে না, তা নির্দিষ্ট করে দেয়ার অধিকার-এখতিয়ার সরকারী কোন কর্মকর্তার আছে কিনা। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সরকার বা খিলাফত ব্যবস্থা ছাড়া প্রচলিত সাধারণ পদ্ধতির সরকারও এটা পারে কিনা। এটা সরাসরি খুতবার ওপর হস্তক্ষেপ, সুতরাং এটা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা সরকার করতে পারে না। এতে কেবল বিতর্ক-বিভ্রান্তি, ক্ষোভ ও অসন্তোষই দেখা দেবে।
প্রশ্ন হলো, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই নির্দেশনা দিতে গেলো কেন? কে বা কারা এর পেছনে প্ররোচক ও নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন? ইমাম খতিব ও ওলামা পরিষদের অন্যতম নেতা মাওলানা আবদুল মতিন বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত কি সরকারের না অতিউৎসাহী কোনো কর্মকর্তার তা স্পষ্ট নয়। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও অহেতুক ইস্যু তৈরিতে ইফা ডিজি সামীম আফজাল বরাবরই খুব পারঙ্গম। এটিও তার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত হতে পারে যা সরকারকে আরো নিন্দিত ও সমালোচিতই করবে। বলাবাহুল্য, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ ও ঘটনায় এটা বিশেষভাবে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে, সরকারের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি ঘাপটি মেরে আছেন যারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও বিতর্কিত ইস্যু তৈরিতে সক্রিয় এবং বিশেষ মতলবে তারা এই কাজটি নীরবে বারবার করে যাচ্ছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ও বিতর্কিত ও অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরির দেদার অভিযোগ। নানা বিষয়ে গুঁয়ার্তুমি, ব্যাপক দুর্নীতি ও ধর্মপ্রাণ জনগণ এবং সরকারের মধ্যে বারংবার ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির অপচেষ্টার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ভূমিকায় সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের ইসলামবিমুখ ইমেজ জনমনে ছড়িয়ে পড়ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগ ও নির্দেশনার পাশাপাশি পুলিশের আইজির সাম্প্রতিক কিছু কথাবার্তাও বিতর্ক ও বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল। ইসলামিক ফাউন্ডেশন যা করেছে তা অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার শামিল। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকাই সবদিক দিয়ে মঙ্গলজনক।
ব্রিটিশ, পাকিস্তানি বা বাংলাদেশের অতীত কোন শাসনামলেই ধর্মীয় অঙ্গনে বিধি-নিষেধ আরোপ বা মসজিদের খুতবা নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা হয়নি। বর্তমান সময়ে যদি এটি করা হয় তাহলে ৯২ ভাগ মানুষ তা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হওয়ায় এতে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান ও যাবতীয় বিষয়ের যথার্থ দিক-নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ ইত্যাদি কিছুই পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোচ্যসূচির বাইরে নয়। জুমার নামাজ হচ্ছে বিশ্বমুসলিমের জন্য ইসলাম শিক্ষার উন্মুক্ত মহাশিক্ষাঙ্গন। অতত্রব, খুতবা ও বয়ান হতে হবে নির্বিঘœ ও পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। এতে বিধিনিষেধ আরোপ, পাহারা বসানো, গোয়েন্দা পাঠানো কোন ধর্মপ্রাণ মানুষই পছন্দ করবেন বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে দেশের ইসলামী নেতৃবর্গ, সর্বস্তরের ইমাম, খতিব ও ওলামা-মাশায়েখ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জনমনেও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়েছে। আশা করি সরকার বিতর্কে জড়াবে না। মসজিদ, খুতবা, জুমা, মাহফিল ও ওয়াজ-নসিহতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে এ সব সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে রাখাই ভালো। সরকারী চাকরিজীবীদের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয় তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কোনকালেই প্রশংসিত হয়নি। এমনকি রুশ বিপ্লবের পর কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন স্থানে জুমার খুতবা নিয়ন্ত্রণের কথা শোনাও যায় না। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ইত্যাদি অঞ্চলেও জুমার খুতবা কিংবা আলেম সমাজের দীনি আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণের কিংবা ইসলামের বিচার, শাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, যুদ্ধ, শান্তি, ইহ ও পরকালীন পথনির্দেশ সম্বলিত আয়াত বা হাদীস বাছাই করে সরকারের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী অনুমতি দেয়া না দেয়ার কোন নিয়ম চালু করা হয়েছে বলে নজির পাওয়া যায় না। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে হঠাৎ কেন এ ধরনের বাছাই ও নিয়ন্ত্রণ চিন্তা এলো তা যথেষ্ট ভাবনার বিষয়। ইফা মহাপরিচালক তার বক্তব্যে বলেছেন, দেশের ৬০ হাজার ওলামা তার নিয়ন্ত্রণে আছেন। প্রতি ইউনিয়নে ৮ থেকে ১২ জন ইমাম, আলেম বা ধর্মশিক্ষক তার নেটওয়ার্কে রয়েছেন। তিনি মসজিদ ও মসজিদের খতিব সম্পর্কে সব খোঁজ-খবর সহজেই পেয়ে যান। এ সব কথা জুমা ও অন্যান্য নামাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টির কারণ হতে পারে বলে দেশের বিশিষ্ট খতিবগণ মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নানা প্রকল্পে যুক্ত ৬০ হাজার ওলামা ইফা ডিজির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন কথাটি ঠিক নয়। এটি ওলামাদের জন্য অবমাননাকর ও সমাজে ইমাম, খতিব, ওলামা-মাশায়েখকে হেয় প্রতিপন্ন করার হীন উদ্দেশ্যপূর্ণ মন্তব্য। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ৬০ হাজারের বাইরে দেশের লাখ লাখ ওলামাকেও ইফা মহাপরিচালক তার কথিত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই সরকারকে এমন পরামর্শ দিচ্ছেন কিনা। পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, এটিই প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।