পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হত্যামামলায় বিচারিক আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আপিল ও রিভিও পিটিশনের সুযোগ থাকে। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারি ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে ১৯৯৪ সালের জুন মাসে ইউপি সদস্য মনোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডের মামলাটি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর তিনজনের ফাঁসি এবং কয়েক জনের যাবজ্জীবন ও খালাস দিয়ে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২ ২০০৮ সালের এপ্রিলে যে রায় দেন তা হাইকোর্টে আপিল শুনানির পর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আসামি আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ু ফাঁসির রায় বহাল রেখে রায় দেন। নিয়ম অনুসারে হাইকোর্টে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের পর সুপ্রিম কোর্টে আপিলের সুযোগ থাকে। সে অনুসারে আসামীদ্বয়ের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার পর তা শুনানির জন্য অপেক্ষমান থাকলেও আপিল নিস্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে। গত মঙ্গল এবং বুধবার মামলাটি শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত ছিল বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। সুপ্রিম কোর্টে আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করায় নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালত এবং বিচার সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এ ঘটনাকে নজিরবিহীন এবং আইনের শাসনের চরম ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছেন।
রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগই নানাভাবে দুর্বল, অস্বচ্ছ ও সমস্যাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বিচারবিভাগও বাদ যায়নি। বিচার বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির চিত্র বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতেরও নজরে এসেছে। গত বছর একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে হাই কোর্টের দুই বিচারক বিচারপতি আশরাফুল কামাল এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের দ্বৈত বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত বিচারবিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনা করা যায় না। তাদের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের সময় এসেছে।’ বিচারকদ্বয় বিচারবিভাগের দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে আরো ভূমিকা রাখার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছিলেন। আপিল নিস্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি চরমভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। এই দাবি যথার্থ। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্তসাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা আবশ্যক।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নামের মিল থাকার কারণে নিরপরাধ মানুষের জেল খাটার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি অর্থের বিনিময়ে অন্যের সাজা ভোগেরও বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসবই বিচারিক প্রশাসনের অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার নজির। চট্টগ্রামের একটি হত্যা মামলায় অর্থের বিনিময়ে নিরপরাধ ব্যক্তির জেল খাটার ঘটনা এবং ঝালকাঠি আদালতে ‘ভুয়া মামলায়’ নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে দেয়ার ঘটনায় গত জুন মাসে হাই কোর্টের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের বেঞ্চ এ ধরনের ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঝালকাঠির ভুয়া মামলার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে গত দুই বছরে একজনের নামে আরেকজন নিরপরাধ মানুষের সাজা খাটার ২৬টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এমন ঘটনা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ধরনের অপরাধ অহরহ ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই জেলখানায় বিচারাধীন মামলার আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও সংঘটিত হলো। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সমাজে নানাবিধ বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের স্বচ্ছতা, সক্ষমতা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের কথিত অস্বচ্ছতা, সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মৃত্যুদণ্ডের মতো সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর করার আগে আইনগত সব সুযোগ সুবিধা ও ধাপ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। যশোর কারাগারে সংঘটিত ঘটনাসহ বিচার ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।