পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দু’ সপ্তাহের উপর হয়ে গেল, কিছুতেই যেন রহস্যে আবৃত সেই দুষ্কর্মের রেশ কাটতে চাইছে না। আলোচনা-সমালোচনা, ঘটনা আর ঘটনার পেছনের ঘটনা- এসব নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ চলছেই। তবে, এটা দিব্যি বলা চলে, বাংলাদেশ প্রাথমিক ধাক্কাটা ঠিকই সামলে নিয়েছে। পর্দার আড়ালের শকুনির দল চেয়েছিল, এদেশে হিন্দু-মুসলিমে একটি ধুন্ধুমার রক্তারক্তি লাগুক। আর তারা পরম আয়েশে মরা লাশের মাংস খুবলে খাওয়ার সুযোগ লাভ করুক। দেশের সরকার ও জনতার সতর্কতায় তাদের সে আশা এ যাত্রা কিছুটা হলেও অপূর্ণই থেকে গেল।
এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। বাকি ১০ শতাংশের বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ঐতিহ্যগতভাবে এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বস্ত ও অনুরাগী হলেও যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। মাঝে-সাঝে এখানে-সেখানে কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম হলেও সেটা কখনোই মারাত্মক দাঙ্গায় রূপ নেয়নি। ১৯৭১ সালে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রাণ বাঁচাতে বাস্তুভিটা ছেড়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। সে আলাদা ব্যাপার। আর তার জন্য দায়ী ছিল পাক হানাদার বাহিনী, এ ভূখন্ডের মুসলিম সম্প্রদায় নয়।
দুষ্টচক্রের হিসেব-নিকেশ ছিল পরিষ্কার। পূজা-মন্ডপে কোনো দেবমূর্তির পায়ের উপর পবিত্র কুরআনের একখানি কপি রেখে দাও। এরপর ফেসবুকে লাইভ করে মুসলিম সম্প্রদায়কে উস্কে দাও। আর যায় কোথায়? সর্বত্র মারদাঙ্গা লেগে যাবে। তবে, তাদের এ হিসাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এদেশের মানুষের ঐতিহ্যগত অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ঘটনাস্থল কুমিল্লার আশ-পাশের জেলাগুলোতে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিলেও সরকার, বিরোধী পক্ষ কিংবা ডান-বাম কেউই, এমনকি বহুল পরিচিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোও এতে কোনো রূপ সমর্থন যোগায়নি। উপরন্তু, জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন সংগঠন সবাইকে নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে দেয়, সাম্প্রদায়িক মতলববাজি এদেশে হালে পানি পাবে না। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে সুদূর রংপুরে যে হাঙ্গামা ঘটে তা কিছুটা কৌতুহলোদ্দীপক। অনেকে মনে করছেন, কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলোতে প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলায় দুষ্টচক্র এখানে সুবিধা করতে না পেরে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে অনেক দূরের ওই জেলাটিকে বেছে নেয়।
তবে, কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ওসি সাহেব যখন পবিত্র কুরআন শরীফটি উদ্ধারে ব্যস্ত, অনতিদূরে জনৈক ব্যক্তি তা ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। এটা কি ওসি সাহেবের জ্ঞাতসারেই হচ্ছিল? এধরনের একটি ঘটনা ফেসবুকে এভাবে প্রচারের ফলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কি তিনি বিবেচনায় নিলে ভালো হতো না? ওই ব্যক্তিকে তো তখনই গ্রেফতার করা জরুরি ছিল। ঘটনাস্থল ও আশপাশের জেলাগুলোতে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন কি আর একটু দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে পারত? হাজীগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যে হতাহতের ঘটনা ঘটে তা কি পরিহারের সুযোগ ছিল? উত্তেজনা প্রশমনে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসমূহ কি তাৎক্ষণিকভাবে একটি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারত? ফেসবুকে দেয়া উস্কানির বিপরীতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কি জরুরি ভিত্তিতে একটি পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা যেত?
আরও কিছু হতাশার দিক আছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষ নির্বিশেষে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসমূহ সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে অবস্থান নিলেও একে অপরের সমালোচনায় মুখর ছিল। সন্দেহ নেই, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের। বিরোধী পক্ষেরও এখানে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ও সুযোগ রয়েছে। আলোচ্য ঘটনার প্রকৃতি বিচারে এটা খুবই স্পষ্ট যে, এটি একটি দেশবিরোধী শক্তির সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, যারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের সময়টাকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির জন্য বেছে নিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো বহিঃশক্তির যোগসাজশ থাকাও অসম্ভব নয়, যারা দেশটিকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে চায়। এহেন পরিস্থিতিতে কি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাই মিলে অভিন্ন কণ্ঠে বক্তব্য রাখা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় না?
বিশেষ আশংকার বিষয় হল, বাংলাদেশে যখন দলমত নির্বিশেষে সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট, পাশের দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের ঘটনাকে ব্যবহার করে সেখানে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহ, বিশেষ করে ত্রিপুরায়, তাদের এই অপচেষ্টা ছিল লক্ষ্য করার মতো। ভারতের বর্তমান শাসকদলের অন্যতম সিনিয়র নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্রেক্ষিতে ভারত সরকারকে বাংলাদেশে আক্রমণের আহ্বান জানান (দ্য উইক, ১৮ অক্টোবর, ২০২১)। শাসক দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ দোসর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জাতিসংঘ, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিকট লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন, একটি সত্যানুসন্ধান মিশন প্রেরণ এবং সহিংসতার শিকারদের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানায় (ইন্ডিয়া টুডে, ২৩শে অক্টোবর, ২০২১)। এগুলো মোটেই কোনো শুভ আলামত নয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে সেদেশে অবস্থানরত বাঙালি মুসলমানদের একটি বড়ো অংশকে নানা ছুতা-নাতায় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এমতাবস্থায়, যদিও ভারত সরকার সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে সরাসরি বাংলাদেশকে কিছু বলেনি, এটাকে পুঁজি করে সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহে দাঙ্গা লাগানোর যে প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে তাকে ওখানকার বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রিফিউজি বানিয়ে এখানে ঠেলে দেয়ার একটি বৃহত্তর নীল নকশার অংশবিশেষ ভাবা কি অমূলক হবে? এ প্রশ্নটি বিশেষভাবে একারণেই উঠতে পারে যে, যারা ওখানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে, তারা মূলত শাসকদল বিজেপির ঘরানার লোকজন। এমনিতেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভারে বাংলাদেশ ন্যুব্জ হয়ে আছে। ভারত সীমান্তে আরেকটি শরণার্থী ফ্রন্ট খোলার মতো সঙ্গতি কি বাংলাদেশের আছে?
বুঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশ কিংবা ভারত কোথাও সাম্প্রদায়িক সংঘাত কল্যাণ বয়ে আনবে না। এদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে বিভিন্ন সময়ে অনেক পরিবর্তন আসলেও বাংলাদেশ কখনোই পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’Ñ এই মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। তবে, মনে রাখা দরকার, একটি দেশের জন্য এই মূলনীতি কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে যখন এটি নিজস্বভাবে একটি শক্ত ভিতের উপর দন্ডায়মান থাকে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে জনতার সামগ্রিক ঐক্যই কেবল একটি দেশকে এ ধরণের সুদৃঢ় ভিত্তি দিতে পারে। একটি জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ থাকে, কেবল তখনই তা বহিঃশক্তির সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত দেখাতে পারে। ৭১-এ এই জাতি পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে নাকে খত দেয়াতে পেরেছিল সর্বস্তরের জনতার মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে উঠেছিল বলেই। আজও জাতির শক্তিমত্তা সেই একই ঐকতানের উপরই নির্ভর করবে। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশ ও জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির অযাচিত অপচয় কেবল তাদেরই কাম্য হতে পারে, যারা এদেশকে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চায় না। দেশপ্রেমিক শক্তিকে এবিষয়ে সদা চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।