Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অসময়ের বন্যায় স্বপ্ন ভেঙে চুরমার কৃষকের মুখে এখন শুধুই হতাশা

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০১ এএম

অসময়ের বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সবার মুখে এখন শুধুই হতাশার ছাপ। বন্যায় সবকিছু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে সামনের দিন কীভাবে কাটাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটছে তাদের।

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারনে দফায় দফায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলায় জুলাই-আগস্ট মাসে পর পর তিন দফা বন্যা হয়। দফায় দফায় বন্যায় এ অঞ্চলের আমনের বীজতলা ও রোপা আমনসহ বিভিন্ন জাতের রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। ধার-কর্জ করে পুনরায় জমি তৈরিসহ আমনের চারা, রবিশস্যের বীজ বপন করেন। বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমনের পাশাপাশি রবিশস্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন অনেকে। আসন্ন শীত মওসুমকে সামনে রেখে আগাম জাতের রবিশস্য চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কৃষকরা। নতুন স্বপ্ন নিয়ে ধার-দেনা করে সার, কীটনাশক প্রয়োগসহ বাড়তি পরিচর্যা করতে থাকেন ক্ষেতের। লক্ষ্য একটাই বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় অসময়ের বন্যায়। ভারত তিস্তার উজানে গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে তিস্তা নদী। পানির প্রবল স্রোতে বেশ কয়েকটি বাঁধ, উপবাঁধ ভেঙ্গে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুরের ১৫টি উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। একদিন পরেই নদীর পানি কমতে থাকলেও তিস্তার চরাঞ্চলসহ নিচু এলাকার পানি নামতে থাকে অনেক ধীর গতিতে। ফলে এক সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরে এসব এলাকার ফসলে ক্ষেত পানির নিচে পড়ে থাকে। পানির নিজে পড়ে থাকায় আমনের ক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে পচন ধরে যায়। এছাড়া বেগুন, মুলা, বরবটি, করলা, পটল, সীম, মরিচসহ শাক-সব্জিসহ আগাম জাতের আলু ক্ষেতে পানি ওঠায় কচি চারাগুলো মরে গেছে। এতে করে ব্যাপক ক্ষতি হয় কৃষকের। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় সব স্বপ্ন। চোখে-মুখে চলে আসে হতাশার ছাপ। ঋণ শোধ এবং পরিবার নিয়ে সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটাবেন -এ চিন্তায় রাতের ঘুম চলে যায়।
নীলফামারী কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ক্ষয়-ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা কৃষি অফিসার মাঠ কর্মকর্তারা ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে অসময়ের বন্যায় এবারে জেলায় প্রায় ২/৩ হাজার হেক্টর জমির ধান ও মৌসুমি সবজি নষ্ট হয়েছে। তবে জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলার কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আশ্বিন-কার্তিক মাসে তিস্তার চরাঞ্চলে শীতকালীন শাকসবজি ছাড়াও ভুট্টা, বাদাম, রসুন, পেঁয়াজ, আলু, মসুর ডাল, ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষ করেছিলেন কৃষকরা। ফসলও ভাল হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ উজান থেকে আসা পানিতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। চরাঞ্চলসহ নদী তীরবর্তী গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় জেলার সদর উপজেলা, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামের ১৮টি ইউনিয়নে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান নিরূপন করা না গেলেও ধারনা করা হচ্ছে আমন এবং রবিশস্য মিলে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রায় দেড় থেকে ২ শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

রংপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ অসময়ের বন্যায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া এবং পীরগাছা উপজেলায় বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিস্তার পানি তোড়ে গঙ্গাচড়া উপজেলার ছালাপাক, চর চল্লিশা, আলমবিদিতর, লটারি, কোলকোন্দ, নোহালী ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলো হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। লটারী ইউনিয়নের চরইশরকুল, ইছলি, পূর্ব ইছলি, পশ্চিম ইছলি ও শংকর, বাগেরহাট, কেল্লারহাটসহ অধিকাংশ এলাকাই পানিতে তলিয়ে আছে। এসব এলাকার অনেক ক্ষেত এখনও হাঁটু পানির নিচে রয়েছে। ফলে আমনের চারাসহ বিভিন্ন শীতকালীন ফসলের ক্ষেতে পচন ধরেছে। সব মিলে প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

পীরগাছা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৪’শ ৬০ হেক্টর জমির রোপা আমন পানিতে তলিয়ে গিয়ে পচে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়াও প্রায় ২’শ হেক্টর জমির সবজি খেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
সরেজমিনে জেলার গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ক্ষেতের করুন চিত্র। যতদুর চোখ যায় ততদুর পর্যন্ত আমন ধানের মাটিতে পড়ে পচে শুকিয়ে যাচ্ছে। সিম, পটল আর করলার ক্ষেতগুলোতে গাছ মরে গিয়ে ফাঁকা মাচা (জাংলি) পড়ে আছে। বেগুন ও মরিচের গাছগুলো থেকে পাতা পড়ে গিয়ে শুধুমাত্র শুকনো ডাল-পালা শোভা পাচ্ছে। কোথাও কোথাও সবুজ ক্ষেতগুলো থেকে মাটি দেখা যাচ্ছে। কোথাও বা হলদে রং ধারন করেছে। একই অবস্থা সর্বত্র।

গঙ্গাচড়ার মহিপুরের কৃষক আতিয়ার জানান, মহিপুর সেতুর কাছে তিস্তার চরে প্রায় ২ একর জমিতে আগাম জাতের আলু আর মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছিলেন। বেশ ভালোই হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ বন্যায় সব নষ্ট হয়ে গেছে। এই ক্ষেত থেকে এখন আর কোনটাই বাঁচানো সম্ভব নয়। একই ভাবে কৃষক আমজাদ জানান, প্রায় ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলেন। বন্যায় সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুধু শুকনো গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী এলাকার আমজাদ হোসেন জানান, আর ১৫/২০ দিন পরেই মাছ তোলার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ বন্যার কারণে প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। আকস্মিক বন্যার করনে পুকুরে জাল দিতে পারেননি। ফলে সব মাছ ভেসে গেছে। এখন পুকুরে কোন মাছই দেখা যাচ্ছে না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ