পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলভাগ তছনছ হয়ে যায়। এ ঝড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও হাজার হাজার ঘর-বাড়ি এবং ব্যাপক ফসলি জমি ধ্বংস হয়। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ উপকূলভাগ রক্ষায় সরকার তখন বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ প্যারাবন ও ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বৃক্ষ রোপণ করে প্রাকৃতিক রক্ষাবুহ্য তৈরি করে। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক এসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ বনরক্ষকের অবৈধ আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে তারা বনের মূল্যবান গাছ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করে, অন্যদিকে বনদস্যুরাও লুটপাট শুরু করে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বনায়ন কর্মসূচি বার বার হোঁচট খাচ্ছে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়েও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালের পর ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে উপকূল রক্ষার জন্য সরকারের উপকূলীয় বনবিভাগের অধীনে চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলার ইলিশিয়া ডেবডেবি এলাকায় বনায়নের জন্য জাপানি এনজিও ওয়াইসকা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। প্রতিষ্ঠানটি বাইন, কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সৃষ্টি করে। দুঃখের বিষয়, এখন এই প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মূল্যবান এই বন রক্ষার পরিবর্তে নিজেই ভক্ষক হয়ে উঠেছেন। তার সহযোগিতায় বনদস্যুরা একদিকে বনভূমি উজাড় করছে, অন্যদিকে প্রতারণা করে বনের জায়গায় চিংড়িঘের তৈরি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
বিশ্বে ম্যানগ্রোভ বন খুব বেশি দেখা যায় না। আমাদের দেশে এই বন যেমন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেও গড়ে তোলা যায়। সুন্দরবনকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই বনের ম্যানগ্রোভ এলাকার আয়তন প্রায় ২০ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার। এত বড় ম্যানগ্রোভ এলাকা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই বন লবণাক্ত পানিতে বেড়ে উঠে। এর গাছপালা লবণসহিষ্ণু। সাগরের নোনা পানির চেয়ে দ্বিগুণ লবণসহিষ্ণু। এর ফলে সাগরের প্রবল ঢেউ সহ্য প্রতিরোধ, ভাঙন রোধ এমনকি সুনামির মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিডর, আইলা, নার্গিসের মতো যেসব ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে সেগুলোর পূর্ণশক্তিকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ঠেকিয়ে দিয়েছে। তা না হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কল্পনাতীত ক্ষতি হতো। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রকৃতির অপার দান প্রাকৃতিক এসব রক্ষাব্যুহ বন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে তো পারছেই না, উপরন্তু এগুলো ধ্বংসে মেতে উঠেছে। নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য উপকূলীয় বনাঞ্চল কেটে উজাড় করে দিচ্ছে। বন কেটে এবং ফসলি জমিতে ক্ষতিকর চিংড়ি ঘের করে অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। সরকার প্রতি বছর উপকূল রক্ষার্থে সবুজ বনায়নে নিরন্তর চেষ্টা এবং কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের উপর, তাদেরই কিছু দুর্নীতিবাজ লোক তা লোপাট করে দিচ্ছে। উপকূলীয় এলাকাকে অরক্ষিত রেখে মানুষের জানমালকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। চকরিয়ায় যে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার বনরক্ষকই ব্যক্তিগত স্বার্থে তা ধ্বংসে মেতে উঠেছেন। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা এই ম্যানগ্রোভ বনে মনুষ্যসৃষ্ট যে তা-ব চালানো হয়েছে, গাছ কেটে ছারখার করা হয়েছে এবং চিংড়ি ঘের বানানো হয়েছে, তা দেখে আফসোস করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। এত বড় ক্ষতি করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি। যতদূর জানা যায়, জাপানি প্রতিষ্ঠানটি এ এলাকাটিকে একটি মিনি সুন্দরবনে পরিণত করেছিল। স্থানীয়ভাবে অনেকে একে সুন্দরবন হিসেবেই আখ্যায়িত করে। এই বনটিই এখন কিছু অসাধু ব্যক্তির লোভ, দুর্নীতি ও বনদস্যুদের লুটপাটের কারণে অনেকটা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। শুধু চকরিয়ার এই বনই উজাড় হচ্ছে না, পুরো উপকূল এলাকায়ও সবুজ বনায়ন কেটে প্লট নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা অনাচারে বন ধ্বংসের খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যেখানে জলবায়ুর পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর এক সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মূল ভূখ-ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে, ভয়ংকর ঝড়ের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, সেখানে যদি এভাবে উপকূলীয় বন কেটে উজাড় করে ফেলা হয়, তবে পরিণতি কী হবে, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অথচ জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় উপকূলে সবুজ বনায়নের বিকল্প নেই। সরকারও এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। এ তুলনায় কাজ কমই হচ্ছে। অর্থাৎ যেখানে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে যথাযথভাবে বনায়ন হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। বনায়ন হলেও তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের অবহেলা এবং রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
বনায়নের নামে লুটপাট এবং বিদ্যমান বন কেটে উজাড় করার মাধ্যমে উপকূল অঞ্চলকে অরক্ষিত করে ফেলা হচ্ছে। উপকূলবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। চকরিয়ায় গড়ে তোলা মূল্যবান ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত। পাশাপাশি উপকূলীয় বনাঞ্চল যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি ও অধিক পরিমাণে ঝড়-সহিষ্ণু বৃক্ষ রোপণ করা প্রয়োজন। এক একটি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কী অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। উপকূলবাসী এখনও আইলা, সিডর ও অন্যান্য ঝড়ের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। এই ক্ষতির মাঝেই কিছু দুর্নীতিবাজ লোকের কারণে সবুজ বন ধ্বংস করার অপকর্ম পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। আমরা মনে করি, উপকূল রক্ষায় বৃক্ষ বেষ্টনী গড়ে তোলার যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটানোর সাথে যারাই সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।