Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বিনিয়োগ যত বেশি হবে, অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে। এক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরন্তর আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিখাত ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে তিনি সউদী আরব সফর করেছেন। সউদী সরকার বাংলাদেশে বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিনিয়োগকারীদের যেভাবে দ্রুত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বিনিয়োগে উৎসাহী করা দরকার, তা করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর আমলার দুর্নীতি ও অদক্ষতা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও এ সমস্যাকে বড় বাধা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ বাড়াতে রোড শো, বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা অহরহ বলছেন, তবে বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবর্তে তা ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। বিগত একদশকে যে হারে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা ছিল, সে হারে বাড়েনি।
সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৬ থেকে ২০২০) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ এসেছে তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। বিনিয়োগ হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের কম। এ চিত্র থেকে বোঝা যায়, দেশে বিদেশি বিনিয়োগের হাল কতটা করুণ। অথচ প্রধানমন্ত্রী বিদেশি বিনিয়োকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছেন। তাঁর এ ঘোষণা ও পরিকল্পনা যে কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের বাস্তাবায়ন করার কথা তা তারা করছে না। বরং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা বাধা হয়ে রয়েছে। কয়েক বছর আগে সউদী আরব দেশে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বিনিয়োগ আর হয়নি। কেন হয়নি তার কোনো কারণ জানা নেই। সউদী আরবে সালমান এফ রহমানের সাম্প্রতিক সফরেও দেশটি বিনিয়োগের কথা বলেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীসহ এ সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বিদেশি বিনিয়োগের পথ পরিস্কার করার কাজ করলেও, কতিপয় আমলা সে পথে পা বাড়াচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আকৃষ্ট করাই সরকারের সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের সবদেশই বিনিয়োগকারীদের পেছনে ঘুরছে। বিনিয়োগে তাদের উৎসাহিত করছে। অথচ আমাদের দেশে ঘটছে উল্টো। কতিপয় আমলার মধ্যে এমন প্রবণতা বিরাজমান, বিনিয়োগকারীরা পেছনে তারা ঘুরবে না, বিনিয়োগকারীরাই তাদের পেছনে ঘুরবে। আমলাদের এই প্রবণতার কারণেই বিনিয়োগকারীরা ফিরে যাচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চাইলে তাদেরকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্মের মধ্যে তাদের আগ্রহ-উৎসাহ বন্দী হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের ইজি ডুয়িং বিজনেস ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮। অন্যদিকে সম্পদ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে যেখানে বিশ্বে গড়ে ৪৭ দিন লাগে সেখানে বাংলাদেশে লাগে গড়ে ২৭১ দিন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বাংলাদেশে লাগে ১৫০ দিনের বেশি যেখানে ভিয়েতনামে লাগে ৩১ দিন, সিঙ্গাপুরে ৩০ দিন, মালয়েশিয়ায় ২৪ দিন এমনকি ভারতে লাগে ৫৫ দিন। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদেরকে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। কতিপয় আমলার দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, অনিশ্চিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, জটিল ট্যাক্স সিস্টেম, সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অথচ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমাদের কার্যকর ক্ষেত্র রয়েছে। সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি জাহাজ শিল্প, ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে অফুরন্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারলে বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। তবে বিনিয়োগের সব সম্ভাবনা এক জায়গায়ই এসে আটকে যাচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এর ফলে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের যেখানে পুনরায় বিনিয়োগ করার কথা, তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। দুর্নীতিবাজ কতিপয় আমলার কাছে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি জিম্মি হয়ে রয়েছে। এদের কারণে দেশে বিদেশি বিনিয়োগের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে রয়েছে, তা বোধ করি সকলেরই জানা। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব মেগা প্রজেক্ট নিয়েছে সেখানেও এই জটিলতা রয়েছে। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি বাড়াতে হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হলেও শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নিতে মেগা প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার সাথে নিরলস কাজ করা জরুরি। ভিয়েতনামের মতো দেশ যেখানে বছরে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হয়, সেখানে আমাদের দেশে বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগ হচ্ছে গড়ে ২.৫১ বিলিয়ন ডলার। এ চিত্র বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে কত বড় বাধা তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। এর মূল কারণ, এ সংশ্লিষ্ট কতিপয় আমলার ব্যর্থতা। তাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে বিনিয়োগের বহু দেশ ও পথ খোলা রয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট আমলাদের পিছনে পিছনে ঘুরতে হবে, এমন ঠেকা তাদের পড়েনি। অন্যদিকে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে এত শক্তিশালী হয়ে যায়নি যে বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া চলতে পারবে। আমরা মনে করি, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বেগবান করার জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নীতি সহজ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহী করে তুলতে যত ধরনের সুবিধা দেয়া দরকার তাই দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। কিছু দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ আমলাদের কারণে দেশের বিনিয়োগ ধীর ও স্থবির হয়ে থাকবে, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
আরও পড়ুন