Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারে নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত রোববার মিয়ানমারের রাখাইনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে একদল সশস্ত্র ব্যক্তির হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী অভিযানের মাধ্যমে রীতিমতো হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশটির নেত্রী অং সান সুচি বলেছেন, তাঁর সরকার ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়’ কাজ করছে। সুচি প্রকারান্তরে এ হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত তার মতো একজন নেত্রীর এ ধরনের মনোভাব পোষণ কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। বলা বাহুল্য, তার কথার জের ধরেই গত বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী এক দিনেই ২৬ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করেছে। অভিযান চলাকালে সংঘর্ষে ১৩ জন পুলিশও নিহত হয়েছে। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত রোববারের হামলার ঘটনার পর থেকে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছে এবং পুরুষ ও তরুণদের দেখলেই ‘জঙ্গি’ হিসেবে অভিহিত করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের এই ‘কড়া’ ও ‘সাঁড়াশি’ অভিযানে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করা সংস্থাগুলো বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর এই অভিযানে বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীই ভুক্তভোগী হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা বিজয় নাম্বিয়ার বলেছেন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতাদের এক জোট হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং বৌদ্ধ-মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে চলমান বিদ্বেষ নিরসনে কাজ করা উচিত। এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানকালে রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে বিবিসি জানিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, একটি অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলাকে কেন্দ্র করে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনী অনেকটা নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যে কোনো ছুঁতোয় দেশটির রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করে না। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর এমন নৃশংস ও অমানবিক হত্যা এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেও মিয়ানমার সরকার তা থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। দেশটির সরকারের আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা দূরে থাক মানুষ বলেই মনে করে না সরকার। তার সর্বশেষ জনসংখ্যা জরিপে রোহিঙ্গাদের মূল নাগরিকের বাইরে ‘আদারস’ বা ‘অন্যান্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা উদ্বাস্তু ও ভাসমান। অবশ্য দেশটির সরকার সবসময়ই মনে করে আসছে, রোহিঙ্গারা নাকি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা বাঙ্গালি। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যুগের পর যুগ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উৎসাদনে অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্বল ফেলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তাদের কক্সবাজারসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ভরণ-পোষণেরও দায়িত্ব নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বহুবার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হলেও মিয়ানমারের আচরণে অনেকটা উদাসীনতা ও অনীহা ফুটে উঠেছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা। তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দুঃখের বিষয়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকার করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। এর সাথে যুক্ত হয় উগ্রবাদী বৌদ্ধ গোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী স্টিম রোলার চালাতে থাকে এবং এখনও চালাচ্ছে। এই নিপীড়ন, বিতাড়ন ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার। এমনকি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা অং সান সুচিও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। ক্ষমতায় আসার পর সমালোচনার মুখে পড়ে কয়েক মাস আগে মুখ রক্ষার্থে অনেকটা দায়সারাভাবে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেন তিনি। তাতেও রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এখন আবার ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ তকমা লাগিয়ে হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পরবাসী করার বা অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেয়ার বিষয়টিকে বৈধতা দেয়ার পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গাদের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে এটাই পরিদৃষ্ট হয়, পৃথিবীতে বসবাস করার জন্য তাদের পায়ের নিচে কোনো মাটি নেই। তারা ভাসমান। বিশ্বে এমন জাতিগোষ্ঠী আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নাই। মানবতার এমন বিপর্যয় এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার।
রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে যে হামলা ও পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তা নিন্দনীয়। তবে এ হামলায় কে বা কারা জড়িত তা এখনও স্পষ্ট নয়। কোনো গোষ্ঠীও এখন পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার করেনি। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী যেভাবে রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা কোনো যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সঠিক তদন্ত ও হামলাকারীদের শনাক্তকরণ ছাড়া তারা যেভাবে রোহিঙ্গাদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে রোহিঙ্গা নিধনের উসিলা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বলা হচ্ছে, অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিনা অপরাধে বা যে কোনো ছুঁতোয় যদি কারও উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হয়, তবে জীবন বাঁচাতে আক্রান্তদেরও প্রতিরোধ করার অধিকার রয়েছে। আমরা মনে করি, পুলিশ ফাঁড়িতে কারা কী কারণে হামলা চালিয়েছে, আগে তার যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন। তা না করে এর দায় পুরো রোহিঙ্গা জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই সঙ্গত ও উচিত নয়। আমরা আশা করব, মিয়ানমার সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান বন্ধ করবে, এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে আহ্বান জানিয়েছে, তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে।

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • md yasin ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ৪:০৩ এএম says : 0
    thanks Inqilab thank you writer
    Total Reply(0) Reply
  • Abdus Salam Akanda ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ৯:০৩ এএম says : 0
    যারা ইসলাম ইসলাম করে বড় বড় ভাষন দেয় তারা মিয়ানমারে মুসলমান নিধনের খবর দেখে চুপ করে আছে কেন?।
    Total Reply(0) Reply
  • Hasan Shahid ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ৯:০৩ এএম says : 0
    Allah tume rokka karo
    Total Reply(0) Reply
  • afzal hossain ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ২:২৮ পিএম says : 0
    আমরা চাই সকল ধর্মের মানুষ একসাথে মিলেমিশে থাকি ,বার্মিজ বৌদ্দ হচ্ছে .........................
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমারে নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা
আরও পড়ুন