২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
আগের দিনে বিয়ের আগে বাড়ির বুড়োবুড়িরা ছেলেমেয়েদের বংশের খোঁজ নিতেন। ছেলের বাবা-মায়ের কোনো রোগ আছে বা ছিল কি না। আজকের বিজ্ঞানের যুগে জন্ম না হলেও তাদের ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, ছেলেমেয়ের বাবা-মায়ের যে রোগ থাকে, ছেলেমেয়েদেরও একই রোগ হয় । এভাবে বংশপরম্পরায় ওই রোগ চলতে থাকে। ছেলেমেয়ের বাবা-মা সুস্থ ও নীরোগ থাকলে সন্তানেরাও নীরোগ ও সুস্থ থাকে। আজ বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির যুগে চিকিৎসকেরাও বিশ্বাস করেন বংশীয় রোগ চিকিৎসাযোগ্য নয়। তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। রক্তের মাধ্যমে রোগ ভেসে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শোনা যায়, ইরানে বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের মেডিক্যাল রিপোর্ট ও বংশের ইতিহাস লাগে। বিষয়টি যে খুবই ভালো, সন্দেহ নেই। সুস্থ পিতামাতা মানে সুস্থ জাতি। তাই ব্যাপারটা সবার ভেবে দেখা উচিত বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
আদ্রিতা একজন গৃহিনী। তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও হৃদরোগী। দু’টি রোগই তিনি পিতামাতা থেকে পেয়েছেন। পিতা হৃদরোগ ও মাতা ডায়াবেটিক রোগী। বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি এটা জেনে সব সময় চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তিনি জেনেছিলেন বাবা- মা যে রোগে আক্রান্ত থাকেন, সন্তানসন্ততিও পিতামাতার রোগে আক্রান্ত হয়। তাই আদ্রিতা সব সময় সচেতন ছিলেন। মাঝে মধ্যে রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। তিনি তার রক্তচাপ ১২০/৮০ রাখার চেষ্টা করতেন। রক্তে শর্করা ছিল ১৮০মি.মোল/লি.। তিনি নিয়মিত চিকিৎকের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। তাদের পরামর্শ মোতাবেক জীবন যাপন করতেন। ছয় মাস অন্তর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক চিনি, লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার খেতেন। দৈনিক চার কিলোমিটার সকাল-বিকাল হাঁটাহাঁটি করতেন। ডাক্তার-নির্দেশিত ওষুধ খেতেন। ডাক্তার বলেছেন, চর্বি ও তেল এড়িয়ে চলবেন। আদ্রিতা বিবাহিত মহিলা। স্বামীকেও তিনি এসব খাওয়াদাওয়ার বিধিনিষেধ মেনে চলতে বলতেন। সব সময় স্বামী-স্ত্রীর ভয়, কার কখন হার্ট অ্যাটাক হয়। কারণ, এ দুটোই আদ্রিতার বংশীয় রোগ।
আদ্রিতার মনে পড়ে, বাবার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তখন তার বয়স ৫০। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। যেকোনো বয়সে যেকোনো সময় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আদ্রিতা নিজেও স্বামীকে এ ব্যাপারটা সব সময় বলতেন। সজাগ রাখতেন। স্বামী বলতেন, সব সময় তোমার এই ভয়ই তোমার হার্ট অ্যাটাকের কারণ হবে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রক্তের চাপ বাড়ে। হার্ট অ্যাটাক হয়। তাই তুমি সব সময় এটা নিয়ে ভেবো না। টেনশন করো না। সম্যাসা যখন আসে সমাধানও বের হয়। এভাবে চলছে আদ্রিতার দিন। সংসারের কাজ, হাটবাজার স্বাভাবিকভাবে চলছে। তবুও মনে সব সময় একটা সংশয়, ভীতি। একদিন হঠাৎ আদ্রিতা জ্ঞান হারান। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। নিজেই নিজের বুক চেপে ধরছেন। স্বামী দেরি না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আদ্রিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছেই দেখেন একদল নার্স প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে আদ্রিতাকে স্ট্রেচারে ধরাধরি করে নিয়ে যায় হাসপাতালের আইসিইউতে। সেখানেও ডাক্তার প্রস্তুত হয়েছিলেন। দ্রুততার সাথে ইনজেকশন পুশ করলেন ডাক্তার। নার্সকে ওষুধ খাওয়ানোর নির্দেশ দেয়া হলো। যে কথা সেই কাজ। সব কিছু দ্রুততার সাথে হচ্ছে। পরিবারের লোকজন আইসিইউর বাইরে অপেক্ষা করছে আবেগ-উৎকণ্ঠায়। ডাক্তার ও নার্স সবাই অপেক্ষমান। ইনজেশকন এবং ওষুধের ফল দেখতে চায়। ধীরে ধীরে সময় পার হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আদ্রিতার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলল আদ্রিতা। ডাক্তার প্রশ্ন করেন, কেমন বোধ করছেন? আদ্রিতা ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেন, ভালো লাগছে । চব্বিশ যন্টা ওখানেই রইলেন আদ্রিতা। তারপর ছুটি।
আদ্রিতাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। ডাক্তারের নির্দেশ ও পরামর্শ মোতাবেক সব কিছু করাতে আদ্রিতা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন। সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম চলে। এভাবে তিন দিন গেল। হঠাৎ এক রাতে আবার হার্ট অ্যাটাক। তখন মধ্যরাত। আবার অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কার্ডিওলজিস্ট এনজিওগ্রাফি করাতে বলেন। তার পরামর্শ মোতাবেক এনজিওগ্রাফি করানো হলো। রিপোর্টে দেখা গেল, হার্টের বাম পাশের ধমনিতে ৯৫ শতাংশ ব্লক এবং প্রধান বা কেন্দ্রীয় ধমনির ৮০ শতাংশ ব্লক। পরামর্শ দেখা হলো অপারেশন। এ উদ্দেশ্যে শরীরের সর্বপ্রকার টেস্ট করার প্রয়োজন। আদ্রিতার প্রস্রাব, মল, দাঁত ইত্যাদি সর্বপ্রকার টেস্ট করানো হলো। সার্জন রিপোর্টে দেখেন প্রস্রাবের ইনফেকশনে অনেক এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। তিনি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। সব কিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হার্টের অপারেশন করানো সম্ভব নয়। প্রস্রাবে ওষুধ খাওয়ানোর পর স্বাভাবিক হলো। তখন সার্জন রোগীর পরিবারকে ডেকে সাত ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেন। রক্তের গ্রুপও জানানো হলো। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত সংগৃহীত হলো। তখন সার্জন অপারেশনের তারিখ দিলেন। নির্দিষ্ট তারিখে চলল ছয় ঘন্টা। চারজন নার্স, সার্জন তার দুইজন সহকারী সহযোগিতায় সফলতার সাথে অপারেশন সম্পন্ন করলেন। রোগীর পা থেকে রগ তুলে নিয়ে সার্জন হার্টে গ্রাফটিং করলেন । ১০ দিন পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন আদ্রিতা। এর পর উনি স্বামীর সাথে কক্সবাজার গেলেন হাওয়া পরিবর্তনের জন্য। সার্জনের নির্দেশ ছিল দৈনিক সকাল-বিকেলে আধা ঘন্টা করে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। আদ্রিতা হাঁটাহাঁটিতে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। ফলে এক রাতে তার আবার হার্ট অ্যার্টাক। এবারকার হার্ট অ্যার্টাক মারাত্মক। আবার হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল আগের অপারেশন কিছুটা ব্যর্থ ও অকার্যকর। সার্জন জানালেন পুনরায় বাইপাস করাও অসম্ভব। অনেক চিন্তাভাবনার পর সার্জন স্টেন্ট লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। যে কথা সেই কাজ। আদ্রিতার হার্টে স্টেন্ট প্রবেশ করানো হলো হার্টের ডান ও বাম পাশে। ফলে এ যাত্রায়ও তিনি বেঁেচ গেলেন সর্বপ্রকার আধুনিক চিকিৎসার বদৌলতে।
সার্জন বলেন, যাদের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে। তাদের বসয় ৪০-৪৫ হলেই সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক ও জরুরি। এ জন্য প্রতি ছয় মাস অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে সর্বপ্রকার সতর্কতা ও সচেতনতা গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসকদের পরামর্শ বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর পারিবারিক ইতিহাস জানা জরুরি এবং পাত্রপাত্রীর মেডিক্যাল চেকআপ করানো অত্যন্ত জরুরি। সুস্থ পাত্রপাত্রী মানে সুস্থ পরিবার।
মো. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট,
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।