পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে অবশেষে একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করতে যাচ্ছে সরকার। দেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় শিক্ষার মানোন্নয়ন সর্বাধিক গুরুত্ববহ বিষয়। প্রায় এক দশক ধরেই বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এক-এগারোর রাজনৈতিক সংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে এই ক্রান্তিকালের শুরু হলেও সূচনা পর্বের সেই সংকট অতিক্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই একটি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপক নয়। রাজনৈতিক নেতারা গণতন্ত্রের চেয়ে কথিত উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলেও একটি সর্বগ্রাসী সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয় দেশের সচেতন জনসমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষত একটি উচ্চশিক্ষিত ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি-লুন্ঠন, ও দুর্বৃত্তায়নের বল্গাহীন আচরণ দেখা যাচ্ছে তার পেছনের কারণ হিসেবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানহীনতাকেই দায়ী করছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা। অতএব সমাজ ও রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারার প্রতিফলন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বর্তমান সরকার একটি নতুন শিক্ষানীতির আওতায় শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুৃনভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে গত সাতবছরেও নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তেমন কোন ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। শিক্ষায় ব্যয়-বরাদ্দের পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার ও উচ্চগ্রেড প্র্প্তা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মানে এর কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়ছেনা বলেই মনে হচ্ছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নানা ধরনের বৈষম্য যেমন আছে, পাশাপাশি তথাকথিত নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক প্রতিযোগিতা, সার্টিফিকেট বাণিজ্য এবং শিক্ষাকারিকুলামে নিয়ন্ত্রণহীনতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ প্রত্যাশিত। কাক্সিক্ষত মানোন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্যোগ হিসেবে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, গবেষণা কার্যক্রম, অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলা ও ঔৎকর্ষ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের প্রশ্ন উঠার পাশাপাশি এতদিন উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ব্যর্থতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ব্যর্থতার অভিযোগ উঠছিল। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ইউজিসি’র আইনগত ক্ষমতা ও দায়-দায়িত্ব অপ্রতুল বলে কেউ কেউ দাবী করলেও ইউজিসি তাদের উপর অর্পিত সুনির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব সমূহও ঠিকভাবে পালন বা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে সব কারণে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক মানোন্নয়নে এতদিন ইউজিসি ব্যর্থ হয়েছে, সেই একই বাস্তবতা যেন প্রস্তাবিত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলতে না পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশ্বের প্রায় সবদেশেই উচ্চশিক্ষার মানরক্ষায় অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল কাজ করে থাকে। দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হচ্ছিল। অনেক দেরিতে হলেও অবশেষে গত সোমবার মন্ত্রী সভায় অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৬’এর খসড়া আইনের অনুমোদিত হয়েছে। গত মার্চ মাসে এই আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রী সভা। একজন চেয়ারম্যান, চারজন পূর্ণকালীন সদস্য এবং আটজন খ-কালীন সদস্য নিয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা আছে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের কার্যক্রমের ভিত্তিতে সনদ প্রদান করবে। দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯৬টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের স্বীকৃতি পেতে হবে। যেখানে উচ্চশিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ক্ষমতা নিয়ে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল কতটা সফল হতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষত শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে পিএসসি, ইউজিসি গঠনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। মূলত সরকারের উচ্চ মহলের এমন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা রোধ করা যাচ্ছেনা। চলমান জাতীয় সমস্যা, সংকট নিরসন এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিনির্মাণের দায়িত্ব দেশের গবেষক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর বর্তায়। বিশ্বের সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন দায়িত্ব পালন করছে। অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা ও গবেষণায় কাক্সিক্ষত মান অর্জনে ব্যর্থ হলেও সঠিক গাইডলাইন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে সে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। ইউজিসি এবং অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের কার্যক্রমে সমন্বয় ও রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা গেলে তা’ অনেকটা সহজতর হতে পারে। প্রস্তাবিত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন ও তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।