পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
টেকসই উন্নয়ন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের ক্ষমতার সাথে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে, যা একই সাথে প্রকৃতি এবং আমাদের ইকোসিস্টেমেও কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলে না। দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে এবং গ্রহকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্দেশ্যগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে নিশ্চিত হয়েছিল যেন সকল ব্যক্তি শান্তি ও সমৃদ্ধি উপভোগ করতে পারে। বর্তমানে, ১৭টি উদ্দেশ্য বিকাশ করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই জীবন গড়ার লক্ষ্যে এবং যার লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, গ্রামে বসবাসকারী জনসংখ্যা হলো ১১ কোটি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৬%। বিশাল এ জনগোষ্ঠির উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব না। তাই বাংলাদেশকে এর লক্ষ্য পূরণ এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ জনগোষ্ঠির উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
এক্ষেত্রে জৈব প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে জীবদের ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় মালামাল তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি। এটি মূলত জীববিদ্যাভিত্তিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি কৃষি, খাদ্য বিজ্ঞান, এবং ঔষধশিল্পে ব্যবহƒত হয়। এতে করে যেমন গ্রামের তথা সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে, সেই সাথে পরিবেশও সুরক্ষিত থাকবে। নিন্মে টেকসই গ্রামোন্নয়নে জৈবপ্রযুক্তির গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তি: গ্রামীণ জনগোষ্ঠির অধিকাংশের পেশা কৃষি হলেও বাংলাদেশে কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে। যার ফলে আমরা যেমন ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদন পাচ্ছি না, তেমনি বিভিন্ন প্রাকৃিতক অবস্থায় আমাদের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে বায়োটেকনোলজির বিকল্প নেই। ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতার জাত, বন্যা-খরা-শৈত্য প্রবাহ সহ্য ক্ষমতা জাত উদ্ভাবন, বড় আকৃতির ফল-ফুল, সবজি-মাছ, পশু-পাখি উৎপাদন, অল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, চাহিদামত জাত উদ্ভাবনসহ কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বায়োটেক ফসলই একমাত্র বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে।
বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে অল্প সময়ে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যায়। কাক্সিক্ষত জাতের ফসল উদ্ভাবন করা যায়। অল্প সময়ে প্রজাতির মধ্যে বিভিন্নতা আনা যায়। বড় বড় সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবন করা যায়। রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যায়। লবণাক্ততা, খরা, বন্যাসহনশীল জাত উদ্ভাবন করা যায়। যেকোন ফসল বছরের যে কোনো সময়ে চাষ করা যায় এমন জাত উদ্ভাবন করা যায়।
অল্প সময়ে অল্প জায়গায় লাখ লাখ চারা উৎপাদন করা যায়। যে সব ফসল, ফল, ফুল, সবজির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় না সেসব গাছের চারা উৎপাদন করা যায়। বছরের যেকোন সময় চারা উৎপাদন করা যায়, মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ করা যায়। উদ্ভিদ প্রজননের জন্য হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা যায়, পশু-পাখির টিকা আবিষ্কার করা যায়। পশু-পাখির রোগের এন্টিবায়োটিক ঔষধ তৈরি করা যায়। নাইট্রোজেন সংবন্ধন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা যায়। যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে মাটিকে উর্বর করে।
জৈবসার ও কীটনাশক: বর্তমানে কৃষিতে ব্যবহƒত বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক যেমন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ, তেমনি তা পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও বটে। এক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যাও সমাধান করা যায়। বিভিন্ন জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জৈবসার ও কীটনাশক তৈরি করা সম্ভব বিভিন্ন আর্বজনা, গোবর, কৃষির পণ্যের অব্যবহৃত অংশ থেকে তৈরি করা সম্ভব। এসব জৈব স্যার মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ফসলের গুণগত মান বাড়ায় এবং গুদামজাত শষ্যের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও এসব সার এবং কীটনাশক মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
জৈব জ্বালানি: বিকল্প জ্বালানির উৎস হিসেবে বায়োগ্যাস একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। বিভিন্ন পচনশীল জৈব পদার্থ বা বর্জ্য পদার্থ যেমন হাস মুরগীর মলমূত্র, গৃহস্থালির বর্জ্য ইত্যাদি বাতাসের অনুপস্থিতিতে পচনের ফলে যে গ্যাস তৈরি হয় তাকে বায়োগ্যাস বলে। তবে গৃহপালিত বা বাণিজ্যিকভাবে পালিত পশুপাখি এবং মানব মল সহজলভ্য বলে এগুলোই বেশি ব্যবহার হয়। এ জাতীয় গ্যাস অধিকাংশ পরিমাণই (৬০-৭০ ভাগ) থাকে মিথেন গ্যাস। বায়োগ্যাস আমাদের জীবনযাত্রার বিশেষ করে গ্রামের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়াও বিদ্যুতের উপর অতিরিক্ত চাপ কমবে। বায়োগ্যাস ব্যবহার করে এই জ্বালানি ব্যবহার যেমন পরিবেশ দূষণ থেকে বাংলাদেশ কে রক্ষা করবে, তেমনি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যও অর্জিত হবে, যা টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্যও বটে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: গ্রাম অঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে বর্জ্য তৈরি হয় তা হলো পচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্য সাধারণত ঠিক মতো ব্যবস্থাপনা করা হয় না, কারণ শহরের মতো বর্জ্য সংগ্রের কোনো ব্যবস্থা গ্রামে থাকে না। কিন্তু জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করা যায়, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে এসব বর্জ্য থেকে মূল্যবান গ্যাস, তেল উৎপাদন করা সম্ভব। যা থেকে গ্রামের মানুষ শক্তির বিকল্প উৎস খুঁজে পাবে। এইসব জ্বালানি যেমন একই সাথে সাশ্রয়ী তেমনি পরিবেশ বান্ধব। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অন্যতম একটি হলো সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বিশাল এই জনগোষ্ঠিকে বাদ দিয়ে কোনোভাবে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব না। তাই টেকসই গ্রামে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই। সে দিক থেকে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং দেশের জনশক্তি কাজে লাগিয়ে বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু শহরের তুলনায় গ্রামে বিভিন্ন শিল্প কল-কারখানার সংখ্যা একদমই কম, এজন্য গ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কল-কারখানা যেমন: বায়োফার্টিলাইজার/জৈবসার, বায়োগ্যাস, বেকারস ইস্ট, সাইট্রিক এসিড উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে শহর অঞ্চলে জনসংখ্যার চাপ অনেকাংশে কমবে এবং গ্রামের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। সেই সাথে পরোক্ষভাবে পরিবেশ দূষণ হতে সুরক্ষিত রাখবে সবাইকে জৈবপ্রযুক্তি।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব না, যদি না বাংলাদশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠির টেকসই উন্নয়ন হয়। এই টেকসই উন্নয়ন সহজতর হবে তখন, যখন জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা হয় গ্রামাঞ্চালে। কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ, সুতরাং কৃষিতেরই জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বের সকল দেশ এখন এইদিকে ঝুঁকেছে। বাংলাদেশকেও টেকসই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের জন্য গ্রামাঞ্চালে জৈবপ্রযুক্তি সহজলভ্যতা এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।