চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান
॥ দুই ॥
এখানে প্রাসঙ্গিক একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলোÑ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে ৪০ হাজার হাদীস সংগ্রহ করেছেন সেখানে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনদের বাণী এবং ফতোয়াও আছে। মুহাদ্দিসীনের পরিভাষায় এগুলোও হাদীস হিসেবে গণ্য। আবু হানীফা (রহ.)-এর যুগে হাদীসের সনদ বা বর্ণনাসূত্র ৪০ হাজারের বেশি ছিল না। এই ৪০ হাজার হাদীসই পরবর্তীতে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের যুগে এসে বর্ণনাসূত্রের আধিক্যের কারণে লক্ষ লক্ষ হাদীসে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ মুহাদ্দিসীনে কেরাম সনদের ভিন্নতাকেও আলাদা হাদীস হিসেবে গণনা করেন। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীসই সনদের ভিন্নতার কারণে ১০-১৫টি হাদীস হয়ে গেছে। সে হিসেবে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কিতাবুল আছারে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন, সেগুলো যদি পরবর্তীতে লিখিত হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে তাখরীজ করা হয় তাহলে সেটা ১০-১৫ গুণ হয়ে যাবে। তাই আবু হানীফা (রহ.) হাদীস কম জানতেন এ জাতীয় আপত্তি তোলার কোনো সুযোগই নেই।Ñ (টিকা, ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৪)
কিতাবুল আছারের মান
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ১২৫ হিজরীর পরে কিতাবুল আছার লিপিবদ্ধ করেন। এখানে তিনি আহকামের হাদীস থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস একত্রিত করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি শাস্ত্রীয় আন্দাযে সুবিন্যস্তভাবে সর্বপ্রথম হাদীসের কিতাব লিখেছেন। ফিকহী অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ আকারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর পূর্বে কেউ কিতাব লিখেননি। যারা টুকটাক লিখেছেন তারা শুধু হাদীস একত্রিত করেছেন, সেটাকে সুবিন্যস্ত রূপ দেননি। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইলমে শরীয়তকে অধ্যায় আকারে সর্বপ্রথম সংকলন করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর অনুসরণ করে ইমাম মালেক (রহ.) (১৭৯হি.) মুআত্তা মালেক লিখেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর আগে এই তরতীবে অন্য কেউ কাজ করেননি।’Ñ (তাবঈযুয সাহীফাহ, সুয়ূতী, পৃ: ৩৬, ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস: ১৬১)
সহীহ বুখারীর আগে সর্বপ্রথম সহীহ হাদীসের কিতাব বলা হয় মুআত্তায়ে মালেককে। হাফেয মুগলতাই এবং আল্লামা সুয়ূতী (রহ.) এই স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এটাও সত্য, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর কিতাবুল আছার লেখা হয় মুআত্তায়ে মালেকের পূর্বে। এখন জানার বিষয় হলো কিতাবুল আছারের হাদীসগুলোর মান কোন্ পর্যায়ের! সে ব্যাপারে আল্লামা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.) (১৪২০হি.) বলেন, ‘আমি কিতাবুল আছারের প্রত্যেকটি রাবী এবং প্রত্যেকটি হাদীস তাহকীক ও যাছাই-বাছাই করেছি। তাহকীকের পর আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তা হলো, কিতাবুল আছারের হাদীসগুলো শুদ্ধতা ও শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে কোনো অংশেই মুআত্তায়ে মালেকের রেওয়ায়াত থেকে কম না। মুআত্তার মুরসাল রেওয়ায়াতের স্বপক্ষে যেমন শক্তিশালী বর্ণনা আছ, ঠিক তেমনি কিতাবুল আছারের মুরসাল হাদীসের স্বপক্ষেও আছে। সুতরাং যে কারণে হাফেয মুগলতাই এবং সুয়ূতী (রহ.)-এর নিকট মুআত্তা সহীহ কিতাব হিসেবে পরিগণিত, ঠিক একই কারণে কিতাবুল আছারও সহীহ পরিগণিত হবে। মুআত্তা ও কিতাবুল আসারের মাঝে ব্যবধান ওটুকুই যেটুকু সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মাঝে। (সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সর্বপ্রথম হাদীসের সহীহ কিতাব হলো ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর কিতাবুল আছার।)Ñ ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬২-১৬৩; আল-ইমামু ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী (রহ.) পৃ: ৫৮, মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হলব)
হাদীস বর্ণনায় ইমাম আযমের সতর্কতা
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেকোনো হাদীস যেভাবে সেভাবে বর্ণনা করতেন না। হাফেয আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ হারেসী (রহ.) ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (১৯৭হি.) থেকে মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেন, ‘হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন তা আর কারও মধ্যে পাওয়া যায়নি।Ñ (মানাকেবে ইমাম আযম, সদরুল আইম্মা ১/১৯৭; ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস: ১৬৭)
হাফেযে হাদীস ইয়াহইয়া বিন মাঈন (রহ.) (২৩৩হি.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা একজন ছেকা (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারী ছিলেন। যে হাদীস তাঁর মুখস্ত থাকতো কেবল সে হাদীসই তিনি বর্ণনা করতেন। আর যেটি মুখস্ত ছিল না সেটি বর্ণনা করতেন না।’Ñ (সিয়ারু আলামিন নুবালা. খ: ৫ পৃ: ২২৪; তারীখে বাগদাদ, খ:১৩ পৃ:৪১৯; আল-ইমামু ইবনে মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, পৃ: ৫৮)
উল্লেখ্য, ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন এমন একজন হাফেযে হাদীস যার ব্যাপারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) (২৪০হি.) বলতেন, ‘ইয়াহইয়া বিন মাঈন যে হাদীস জানেন না, সে হাদীস হাদীসই নয়।’ তাহলে ইয়াহইয়া বিন মাঈনের মতো ব্যক্তিত্ব যখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে ছেকা বলে এমন ভূয়সী প্রশংসা করেন তখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমেয়।
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাফেযে হাদীস ছিলেন
একজন রাবী বা বর্ণনাকারী হিসেবে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ছিল, সে বিষয়ে আসমাউররিজালের কিতাবে সবিস্তার আলোচনা আছে। হাফেযে হাদীস আল্লামা শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে হাফেযে হাদীসদের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যাহাবী (রহ.) হাফেযে হাদীসদের জীবনী নিয়ে ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ নামে একটি কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাবে তিনি ‘আল-ইমামুল আযম আবু হানীফা’ শিরোনাম দিয়ে আমাদের ইমামের জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন।Ñ (তাযকেরাতুল হুফফায, খ:০১ পৃ:১৬৮)
পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) আইম্মায়ে জারহ ওয়া তাদীলের একজন ছিলেন। অর্থাৎ তিনি এমন একজন হাদীস বিশারদ ছিলেন যিনি অন্য হাদীস বর্ণনাকারীর ব্যাপারে বলতে পারতেন যে, তিনি রাবী হিসেবে সহীহ নাকি যঈফ, তার বর্ণনা গ্রহণ করা যাবে কি যাবে না ইত্যাদি। আর আবু হানীফা (রহ.) এ কাজটি করেছেনও। আল্লামা যাহাবী (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘হিজরী দেড়শ’ শতাব্দীর দিকে যখন তাবেঈগণ দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন কিছু বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম হাদীস বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা ও দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেন। যেমন আবু হানীফা (রহ.) বলেন, আমি জাবের জু’ফী থেকে মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখিনি।Ñ (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ৭০; আল-ইমামু ইবনু মাজাহ ওয় কিতাবুহুস সুনান, পৃ: ৬২)
সুতরাং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যে একজন হাফেযে হাদীস ছিলেন এবং জারহ ও তাদীলের ইমাম ছিলেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই্। আইম্মায়ে হাদীস এবং আইম্মায়ে জারহ ও তাদীলের মধ্যে যারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ছেকা বা নির্ভরযোগ্য হওয়ার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন(২৩৩হি.), কাসেম বিন মাআন(১৭৫হি.), মালেক বিন আনাস(১৭৯হি.), ইবনে জুরাইজ(১৫০হি.), ইয়াযিদ বিন হারুন(২০৬হি.), আবদুল্লাহ বিন মুবারক(১৮১হি.), সুফয়ান সাওরী(১৬১হি.), শাদ্দাদ বিন হাকীম, ইয়হইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তান(১৯৮হি.), শামসুদ্দীন যাহাবী(৭৪৮হি.), হাফেয মিযযি (৭৪২হি.), ইবনে হাজার আসকালানী(৮৫২হি.) প্রমুখ (রাহিমাহুমুল্লাহ)। এসকল হাফেযে হাদীস এবং মহামনীষীদের পক্ষ থেকে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে নির্ভরতা ও তাওছীকের সাক্ষ্য দেয়াই তাঁর জন্য যথেষ্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।