হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফার রহ. শ্রেষ্ঠত্ব
প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম
মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান
॥ শেষ কিস্তি ॥
আল্লামা ইবনে আদী (৩৬৫হি.) এবং খতীবে বাগদাদী (রহ.)সহ যারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর সমালোচনা করেছেন, তাদের সেই সমালোচনা একেবারেই পক্ষপাতদুষ্ট এবং মনগড়া। বাস্তবতার সাথে যার সামান্যতম সম্পর্কও নেই। এ কারণেই হাফেয মিযযি, হাফেয যাহাবী, ইবনে হাজার আসকালানী, আল্লামা ইবনে কাসীর, ইমাম নাবাবী, আল্লামা সামআনী (রহ.)সহ যারা আসমাউর রিজালের কিতাব লিখেছেন, তারা ইবনে আদী এবং খতীবে বাগদাদীর সমালোচনার প্রতি ভ্রুক্ষেপই করেননি। সেই জায়গায় দুইদিন আগে নাসীরুদ্দীন আলবানী মরহুম এসে ইবনে আদী এবং খতীবে বাগদাদীর কথার ওপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে যঈফ এবং অনির্ভরযোগ্য বানিয়ে ফেলেছেন!! সত্য দেখেও যারা অন্ধ সাজেন তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। (আরও দেখুনÑ মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস)
ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে সমালোচকরা ‘কাইয়াস’ বলে। তিনি না কি কুরআন হাদীস বাদ দিয়ে নিজের মস্তিস্কপ্রসূত মনমতো মাসআলা বানিয়েছেন! কোনো বিষয়ে সরাসরি সহীহ হাদীস থাকা সত্ত্বেও আবু হানিফা (রহ.) নাকি হাদীস গ্রহণ না করে নিজের সিদ্ধান্তানুযায়ী হাদীস বিরোধী ফয়সালা দিয়েছেন!! একটা মানুষের ওপর মিথ্যা অপবাদ লাগানোরও একটা সীমা থাকে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ক্ষেত্রে সমালোচকরা মনে হয় সেই মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছেন। না হয় এমন গোয়েবলসীয় চরম মিথ্যাচার তারা কীভাবে করেন? মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খেস্তি-খেউর এবং বালখিল্যতা প্রদর্শনেরও একটা সীমা থাকা উচিৎ।
বাস্তবতা হলো, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কোনো মাসআলা সমাধানের ক্ষেত্রে সহীহ হাদীস বাদ দেয়া তো দূরের কথা, যঈফ হাদীসও বাদ দেননি। অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে যেখানে কেয়াস এবং যঈফ হাদীস বিপরীতমুখে অবস্থান করেছে, এ ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কেয়াস অনুযায়ী আমল না করে যঈফ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আল্লামা আবদুল হাই লাখনাবী (রহ.) (১৩০৪হি.) বলেন, ‘ইমাম ইবনে হাযম (রহ.)(৫৫৬হি.) এ বিষয়ে ইজমা দাবি করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মাযহাব হলো, তাঁর নিকট যঈফ হাদীস কেয়াস থেকে উত্তম।’Ñ (আল-আজওয়ীবাতুল ফাযেলাহ ফিল আসইলাতিল আশারাতিল কামিলাহ, আবদুল হাই আল-লাখনাবী পৃ: ৪৯, মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হলব)
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) (৭৫১হি.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর শিষ্যরা এ বিষয়ে একমত যে, তাঁর নিকট যঈফ হাদীস কেয়াস এবং যুক্তি থেকে উত্তম। এটার ওপরই হানাফী মাযহাবের ভিত্তি।’ Ñ(ইলামুল মুয়াক্কিয়ীন, ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়া খ: ০১ পৃ: ৭৭)
এমন অসংখ্য মাসআলা আছে যেখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যঈফ হাদীসকে কেয়াসের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন, নিজের যুক্তিকে প্রাধান্য দেননি। তারপরও ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-কে ‘কাইয়াস’ বলার কী কারণ সেটা সমালোচনাকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তাদের এই সমালোচনা যে বাস্তবতা বিরোধী তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। শুধু উদাহরণস্বরূপ কয়েকটা মাসআলা এখানে পেশ করছি যেখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যঈফ হাদীসের কারণে কেয়াস ছেড়ে দিয়েছেন।
১. নামাযে অট্টহাসির কারণে অযু ও নামায উভয়টি নষ্ট হয়ে যায়। ২. খেজুর ভেজানো মিষ্টি পানি দ্বারা অযু করা বৈধ। ৩. হায়েযের সর্বোচ্চ সময়সীমা ১০ দিন। ৪. দশ দিরহামের কমে মহর হয় না। ৫. কোনো ব্যক্তি দশ দিরহামের কম চুরি করলে তার হাত কাটা যাবে না ইত্যাদি। এ মাসআলাগুলো যুক্তি বিরোধী। কিন্তু যঈফ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হওয়ায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যুক্তি ছেড়ে হাদীস অনুযায়ী আমল করেছেন।
ওপরের পুরো আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) একজন হাদীস বিশারদ ছিলেন। একজন মানুষের হাদীস বিশারদ হওয়ার জন্য যতগুলো গুণ থাকা দরকার তার সবই আবু হানীফা (রহ.)-এর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তিনি হাফেযে হাদীস ছিলেন। তিনি হাদীসের কিতাব লিখেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি হাদীস এবং হাদীস বর্ণনাকারীর সহীহ যঈফ নিরূপনকারী। তিনি হাদীসকে কেয়াসের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন, হাদীস অনুযায়ী আমল করেছেন। তারপরও কেউ যদি বলে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস জানতেন না এবং বুঝতেন না তাহলে তার ওপর আমাদের আফসোস করা ছাড়া কী-ইবা বলার আছে! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন, আমীন॥
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া