পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার। এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ২০ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার দুইটি স্থানে তিনটি আত্মঘাতী বোমা হামলা হয় এবং তৃতীয় স্থানে চতুর্থ আত্মঘাতী বোমা হামলার পূর্বেই বিমানটি আছড়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। প্রথম দুটি বিমান ঘন্টায় ১০০ মাইল বেগে টুইন টাওয়ার নর্থ এবং টুইন টাওয়ার সাউথে আঘাত করে এবং বিস্ফোরিত হয়। তৃতীয় বিমানটি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনে আঘাত করে। চতুর্থ বিমানটি আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। মার্কিন সরকার বলে যে, চতুর্থ এই বিমানটির টার্গেট ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউস। এসব হামলায় নিহত হন বিশ্বের ৫০ টিরও বেশী দেশের ৩০০০ (তিন হাজার) মানুষ। এসব হামলার জন্য আমেরিকা দায়ী করে আল-কায়েদা এবং তার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে। তখন আফগানিস্তানে ছিল তালেবান সরকার এবং তাদের আমিরুল মুমিনিন ছিলেন মোল্লা ওমর। আমেরিকা অভিযোগ করে যে, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার নেতারাও আফগানিস্তানে আছে। তাদেরকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মোল্লা ওমর বলেন, ওসামা বিন লাদেনের নির্দেশেই যে আল-কায়েদা টুইন টাওয়ারে হামলা করেছে তার সপক্ষে প্রমাণ দেওয়া হোক। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ বুশ। তিনি মনে করেন যে, এসব যুক্তি দিয়ে তালেবান সরকার সময় ক্ষেপণ করছে। তাই আল-কায়েদাই যে এ কাজ করেছে তার সপক্ষে কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ না দিয়েই ৯/১১ এর ২৬ দিনের মাথায় ৭ অক্টোবর ন্যাটোমিত্রশক্তি সহ আমেরিকা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালায়।
আফগানিস্তানে ছিলনা কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী, উল্লেখ করার মতো কোন বিমান বা সাঁজোয়া বাহিনী। তাই মশা মারতে কামান দাগার মত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ ২০ টিরও বেশি ইউরোপীয় দেশসহ আফগানিস্তানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমেরিকা। ১৭ ডিসেম্বর তালেবান সরকারের পতন হয় এবং আমেরিকা দেশটি দখল করে। সারাদেশে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্যের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে চিরুনি অভিযান চালিয়েও ওসামা বা আল-কায়েদার কোনো খোঁজ পায়নি তারা। তারপরও আমেরিকা আফগানিস্তানকে পদানত রাখল কেন? এটিই হলো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। শুধুমাত্র ওসামা বিন লাদেনকে ধরার জন্যই কি তারা আফগানিস্তান দখল করে? ২০১০ সাল পর্যন্ত ওসামাকে ধরা যায়নি। এই ১০ বছরে তারা সেখানে কেন থাকলো? ওসামাকে মার্কিন কমান্ডোরা হত্যা করে ২০১১ সালে। তাও আফগানিস্তানে নয়, পাকিস্তানে। তারপরও মার্কিনিরা আরো ১০ বছর আফগানিস্তানকে পদানত রাখল কেন?
দুই
এসব হলো জলন্ত প্রশ্ন, যার বিশ্বাসযোগ্য উত্তর ২০ বছর পরেও পাওয়া যায়নি। এসব প্রশ্নের সূত্র ধরে আরো একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। সেটি হলো, টুইন টাওয়ারে কারা হামলা চালিয়েছিল? আদতেই কি ওসামা এবং আল-কায়েদা এই হামলার জন্য দায়ী? ২০ বছর পার হয়ে গেল। আমেরিকা এই প্রশ্নের কোন যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দিতে পারেনি। জীবিত থাকাকালে ওসামা অসংখ্যবার বলেছেন, তিনি বা আল-কায়েদা জড়িত নয়। জীবিত থাকাকালে মোল্লা ওমর বেশ কয়েকবার ওসামাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন। মোল্লা ওমরকেও ওসামা বলেছিলেন, তিনি এই কাজ করেননি।
আমেরিকা অভিযোগ করে যে, চৌকস নেতা খালিদ শেখ মুহাম্মদের পরামর্শ এবং প্ল্যান মোতাবেক ওসামা টুইন টাওয়ারে হামলা করেছেন। সেই খালিদ শেখকে ২০০৩ সালে পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর তাকে কিউবার গুয়ান্তানামো মার্কিন নৌ ঘাটিতে অবস্থিত কারাগারে নেওয়া হয়। তাকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়। ১৭ বছর পার হয়ে গেল। আজও তার বিচার শেষ হয়নি। কেন এমন অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিচার ১৭ বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে? ওসামা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাসভবনে সস্ত্রীক বাস করছিলেন। ২০১১ সালে পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না নিয়ে মার্কিন নৌ কমান্ডোরা ঐ বাসভবনে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে ওসামার পত্নীকে গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর পরপর ৫/৬ টি গুলি করে ওসামার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর বিমানে তার লাশ তুলে আরব সাগরে নিক্ষেপ করে। প্রশ্ন, ওসামাকে কেন হত্যা করা হলো? কেন তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার ওপেন ট্রায়াল বা প্রকাশ্য বিচার করা হলো না?
মার্কিনীরাই বলেছে যে, টুইন টাওয়ার অপারেশনে ছিল ১৯ সদস্যের একটি টিম। এই টিমের ১৫ জনই ছিল সৌদি নাগরিক। একজনও আফগান ছিল না। তারপরেও কেন আফগানিস্তান দখল করা হলো?
গত ৫ সেপ্টেম্বর রবিবার বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, হামলায় নিহতদের পরিবারের লোকজনের বিশ্বাস, সরকারি তদন্তের গোপন নথিতে ঐ হামলায় আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, উদ্ধারকাজে অংশ গ্রহণকারী মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ গত আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এতে তারা অভিযোগ করেছেন, মার্কিন প্রশাসন ইচ্ছে করেই তদন্ত রিপোর্টটি গোপন রেখেছে। এই চিঠির উত্তরে ৪ অক্টোবর শনিবার প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই মর্মে একটি নির্দেশে সই করেছেন যে, টুইন টাওয়ার সংক্রান্ত এফবিআইয়ের তদন্ত নথি আগামী ৬ মাসের মধ্যে উন্মুক্ত বা অবমুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ এই উন্মুক্ত করার বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।
তিন
তদন্তের গোপন ফাইল উন্মুক্ত করার জন্য ছয় মাস সময় কেন লাগবে, সেটি বোধগম্য নয়। তবুও বিশ্বের ন্যায়পরায়ন এবং বিবেকবান মানুষ ঐ ৬ মাস গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে প্রতীক্ষা করবেন, থলি থেকে কোন বিড়াল বেরিয়ে আসে। কারণ, টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগনে হামলা নিয়ে একরাশ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঐসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি। এসব প্রশ্ন বাংময় হয়ে উঠেছে গত ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার একটি কর্পোরেট হাউজের দৈনিক পত্রিকায়। চতুর্থ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক এবং মার্কিন জনগণের বিরাট একটি অংশ এই ঘটনাকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে মনে করেন। তাদের মতে, এটা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অথবা ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের’ কাজ। ফরাসি সাংবাদিক থিয়েরি মেইসান এ সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন। নাম, ‘৯/১১: বড় মিথ্যা’। এই পুস্তকে বলা হয়েছে, ৯/১১ এর পেছনে রয়েছে যুদ্ধাস্ত্র শিল্প এবং মধ্যপ্রাচ্যে তেলের পাইপ লাইন বসানো। ‘গোল্ডেন পাম’ নামক একটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে যে, টুইন টাওয়ারে প্রথম বিমানটির আঘাত হানার কথা যখন প্রেসিডেন্ট বুশকে জানানো হয়, তখন তিনি ফ্লোরিডায় শিশুদের একটি স্কুলে অবস্থান করছিলেন। তাকে দ্বিতীয় বিমানের আঘাত হানার কথা জানালেও তিনি ভাবলেশহীনভাবে শিশুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
টুইন টাওয়ারের কাঠামো ছিল স্টিলের। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগুনের কারণে স্টিল ফ্রেমের কোন অস্ত্রভেদী দালান ভেঙে পড়েছে এমন কথা বিগত ১০০ বছরেও শোনা যায়নি। এ ধরনের ভবনে যে ধরনের ইস্পাত ব্যবহার করা হয় তা উন্মুক্ত স্থানে তাপমাত্রার কারণে গলতে পারেনা।
বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) তৃতীয় ভবনটি টুইন টাওয়ার থেকে ৩৫০ ফুট দূরে। এটি ৭ নং ভবন হিসেবে পরিচিত। প্রখ্যাত কলামিস্ট এবং বুদ্ধিজীবী রবার্ট ফিস্ক লিখেছেন, এই তৃতীয় ভবনটি ধসে পড়লো কেন? এটায় তো কোন বিমান আঘাত করেনি। তাহলে কি বিমানের আঘাতে নয়, এমন কোনো শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে যে ধরণের ডিনামাইট দিয়ে পাথরের পাহাড় ভাঙা হয়?
এবার পেন্টাগনে হামলা প্রসঙ্গ। পেন্টাগনের নিরাপত্তাকে বলা হয় সূচিভেদ্য। অর্থাৎ যেখানে বিনা অনুমতিতে সূচও ঢুকতে পারে না। টুইন টাওয়ার আক্রান্ত হওয়ার ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর পেন্টাগনে হামলা হয়। এই লম্বা সময় সেখানে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? রবার্ট ফিস্ক লিখেছেন, টুইন টাওয়ার হামলার এত ভিডিও ফুটেজ বের হয়, কিন্তু পেন্টাগন হামলার কোন ভিডিও ফুটেজ বের হয়নি কেন? ৯/১১ এর ভয়াবহ হামলার পরপরই ধ্বংসাবশেষের আলামত নষ্ট করা হয়েছে কেন?
আছে, এই ধরনের আরও অসংখ্য প্রশ্ন আছে। একটিমাত্র কলামে সেগুলো লিখে শেষ করা যাবে না। এখন দেখতে হবে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে গোপন নথি উন্মুক্ত করার কথা বলেছেন সেখান থেকে কি বেরিয়ে আসে।
কিন্তু একটি বিষয় বোদ্ধা মানুষদের নজর এড়ায় নাই। সেটি হলো, নাইন ইলেভেনের ৫ দিন পর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাংবাদিকদের কাছে করা একটি মন্তব্য। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে সাংবাদিক টেরী প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চান যে, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল সন্ত্রাস দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিক ক্ষমতা দিতে চান। এ ব্যাপারে আপনার মত কি? উত্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘Terry, I ask you to talk to the Attorney General. ...... This is a new kind of evil. And we understand. ..... This CRUSADE, this war on terrorism is going to to take a while. And the American people must be patient.’ প্রেসিডেন্টের উত্তর, ‘টেরী, আমি আপনাকে বলব অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে কথা বলতে। এটি একটি নতুন ধরনের অপরাধ। এবং সেটা আমরা বুঝি। ....... এই ক্রুসেড, এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিছুটা সময় লাগবে। এজন্য মার্কিন বাসীকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে।’
প্রশ্ন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে বিগত ২০ বছর ধরে আমেরিকা যে যুদ্ধ চালালো সেটা কি একটি ক্রুসেড? মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ? তাই যদি না হবে তাহলে আফগানিস্তানে সামরিক হামলার মাত্র দেড় বছর পর ১ লক্ষ ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে আমেরিকা ইরাকে সামরিক অভিযান চালালো এবং দখল করল কেন? কেন ২০১১ সালে লিবিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো সামরিক অভিযান চালালো? কেন ২০১৭ সালে সিরিয়ায় আমেরিকা সামরিক অভিযান চালায়? কেন সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো? কেন কর্নেল গাদ্দাফিকে বিভৎসভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হলো? কেন মোল্লা মনসুরকে ড্রোন হামলায় হত্যা করা হলো? কেন নিরস্ত্র ওসামাকে হত্যা করা হলো? কেন শুধুমাত্র মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধেই মিলিটারি অ্যাকশন?
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। এখনও তারা ঘুমিয়ে আছে। তাদের জাগতে হবে।
E-mail: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।