পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রাতিষ্ঠানিক কালচার কিংবা ইনস্টিটিউশনাল কালচার, যা আমরা প্রচলিত ভাষায় সিস্টেম বলে থাকি, তা একটি রাষ্ট্রের জনকল্যাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয়। একটি প্রতিষ্ঠানে কেমন কালচার বা সিস্টেম বিদ্যমান তার উপর নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে একজন সাধারণ নাগরিক কেমন সুবিধা বা সার্ভিস পাবেন। এটি শুধুমাত্র কতিপয় ব্যক্তির উপর নির্ভর করে না। ব্যক্তির মান-অভিমান আছে, সমাজ-পরিবার আছে, আবেগ আছে, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতা আছে। এই মান-অভিমান, আবেগ ও ব্যক্তিগত প্রভাবক অনেক সময় প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে। ব্যক্তির সেই সমস্ত নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জনগণ যেনো কল্যাণ ও সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক কালচার প্রয়োজন। আমরা নিয়ম-নীতি বলছি না। নিয়মনীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে যে বাস্তবিক নজির স্থাপন করা হয়, সেটাই কালচার। প্রতিষ্ঠান সেটা সেবামূলক হোক, রাষ্ট্রীয় হোক কিংবা সামাজিক হোক, তার নিজস্ব কালচার থাকতে হবে। এই কালচার কেন দরকার?
১. এই ধরুন চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নিয়ে, সেবার মান নিয়ে বিশেষ করে ডাক্তারদের পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতা এবং সেবিকাদের আন্তরিকতা নিয়ে কথা হচ্ছে। আবার অনেকেই এগুলোর সাথে বাইরের দেশের সেবার মান তুলনা করে দেখান যে, আমরা কতো অসহায় অবস্থায় আছি। কিন্তু রোগীদের পরম সেবায় সুস্থ করে তোলা, আন্তরিকতা নিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করা এই জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক কালচার আমাদের দেশে কি আদৌও ছিল? এসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদানকারী আইন কিন্তু আছে। আপনি আইন পেশায় যান, সেখানেও কি মক্কেলদের সমস্যা সমাধানে আইনজীবীদের সামগ্রিক আন্তরিকতার সংস্কৃতির চর্চা আছে? যেভাবেই হোক, বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার পেতে সমস্ত আন্তরিকতা ঢেলে দেয়া হবে এই পেশার সাথে জড়িত লোকদের মহান ব্রত। বাস্তবে এমন কালচার কি আছে? এমন ব্রত হওয়ার আইনগত ও পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে যদিও আইন আছে, কিন্তু কালচার হিসেবে আমরা কি তা চর্চা করি?
২. পুলিশের ক্ষেত্রে আসুন, আপনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যা যা প্রত্যাশা করেন, যেমন তারা অপরাধ তদন্তে নিরপেক্ষ থাকবে, আইন প্রয়োগে একজন নাগরিকের লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, জাত, জন্মস্থান, রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে নিরপেক্ষভাবে আইনানুগ ব্যবহার করবে, তা কি পাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের আছে? আইনে কিন্তু সবই আছে। সাংবাদিকদের পেশাদার না বলে গালি দেয়া হয়, তাদের সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। কিন্তু নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার সংস্কৃতি কি গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে? বরং যখন যারা ক্ষমতায় থাকবে তারা যেভাবে চায় সেভাবে কিংবা যেটা মার্কেটে হিট ও ভিউ পায় সেটাই কন্টেন্ট বানাতে হবে এমন সংস্কৃতি চলে আসছে। নিয়মনীতি কিন্তু বলছে, জনকল্যাণ হয় এমন বিষয় ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পেশাদারিত্ব নিয়ে পরিবেশন করা আবশ্যক।
৩. একইভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, সেটা নির্বাচন অফিস হোক, পাসপোর্ট অফিস হোক, কিংবা ভূমি অফিস হোক, আপনি এমন প্রবণতা কখনো কি দেখেছেন যে, তারা এমন সংস্কৃতি নিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে যেন আপনার কল্যাণই তাদের একমাত্র দায়িত্ব এবং আপনাকে আপনার প্রয়োজন মতো সেবা দেয়ার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কালচার সবসময় প্রস্তুত। বরং আপনি ভিন্ন কালচার দেখতে পাবেন। অথচ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব নিয়মনীতি দ্বারা পরিচালিত হয় তা কিন্তু সাধারণের প্রত্যাশিত সেবা প্রাপ্তির কালচার গড়ে তোলার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে, শুধু সুন্দর সুন্দর আইন, নিয়মনীতি থাকলে জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে না। আইন অনুসারে সেবা দেয়ার কালচার চর্চা করতে হবে। আইন এবং সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। সংস্কৃতি সেটাই যেটাতে মানুষ অভ্যস্থ এবং যা করতে সে ভালোবাসে ও চর্চা করে। আপনি অনেক ভালো ডাক্তার, আইনজীবী, পুলিশ, সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তা পাবেন যারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যতো নিষ্ঠ, এমনকি তার চেয়েও তারা বড় মনের মানুষ, ভালো মানুষ। ব্যক্তি হিসেবে তারা অসাধারণ। কিন্তু তাদের এই অসাধারণত্ব তারা অনেক সময় হয়তো প্রতিষ্ঠানে দেখাতে পারেন না, কিংবা দেখানোর সুযোগ নেই, অথবা দেখাতে পারলেও সেটা কম। কারণ, প্রতিষ্ঠানে সেই কালচার নেই। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তেমন কালচার চর্চা করার মতো অবস্থায় আমরা নিয়ে যেতে পারিনি। আছে অন্য কালচার, যার সম্পর্কে আপনারা অবগত। ঐ বিদ্যমান সামষ্টিক কালচারে ব্যক্তিগত কালচার চর্চা করা সম্ভব হয় না। এই কারণে মানুষ ঐ ভালো ব্যক্তি কী করছে তার চেয়েও বড় করে দেখে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কী কালচার প্রচলিত এবং সেটা নিয়ে কথা বলে ও সমালোচনা করে। এই সমালোচনা দেখে অনেক সময় ঐ প্রতিষ্ঠানের ভালো ব্যক্তিদেরও ব্যক্তিগতভাবে খারাপ লাগে। যাই হোক, সেটা অন্য আলোচনা। প্রশ্ন হচ্ছে এই কালচার কীভাবে তৈরি হবে? কালচার তৈরির সাথে আইন, পলিসি, রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং জনগণের ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত গুণাবলী জড়িত। সবগুলো ঠিকমতো কাজ করলে পজিটিভ কালচার তৈরি হয়। কালচার তৈরি করতে হয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আইন করে কালচার তৈরি করা যায় না। আইন কালচার কী হবে সেটা বলে দেবে, কিন্তু এই কালচার তৈরিতে লাগবে দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য প্রয়োজন মানসিকতা। এই মানসিকতা ভালোকে আপহোল্ড করার ও মন্দকে তিরস্কার করার মানসিকতা। সেই মানসিকতা তৈরি হয় অগ্রজদের অনুসরণ করে কিংবা প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গের জন্য শাস্তির ভয় থেকে। যেমন আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণ, তিনি হবেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। এটা রীতি। এমন রীতি ভারতেও আছে। ১৯৫৬ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি এই রীতি অনুসরণ না করে কর্মে প্রবীণ না, দ্বিতীয়, এমন একজনকে প্রধান বিচারপতি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাব ঐ বিচারপতি নাকচ করে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বিচারপতি হিসেবে সিনিয়রকে সুপারসিড করতে চাননি। এই যে তিনি রীতি মেনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, সেটাই কালচার হয়ে গেল ভারতে। আজ পর্যন্ত সেই কালচার চলমান আছে। অথচ, আমাদের দেশে এই রীতি অনেক বার লঙ্ঘিত হয়েছে। কারণ, আমরা এই রীতিকে কালচারে পরিণত করতে পারিনি। কালচার তৈরিতে এভাবে সবার ত্যাগ লাগে, সব প্রতিষ্ঠানে সেরকম পলিসি লাগে এবং একই সাথে সেই পলিসি যারা বানান তাদের সততা লাগে। ভালো কালচারগুলো তৈরি করতে মানুষকে সব সময় বাধা দেয় তার ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা দলগত স্বার্থ অথবা স্বজনপ্রীতির মতো বিভিন্ন প্রীতি। এইসব স্বার্থ থেকে বের হয়ে জনকল্যাণমূলক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পলিসি ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন।
লেখক: লেকচারার, আইন বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।