Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সমাধান না হলে আবারও পতন ঘটবে তালেবানের

আফগান অর্থনীতি, অবকাঠামো, জাতিগত সঙ্ঘাত

ডানা ইশরাত | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:১০ এএম

১৯৮০-এর দশকে লাগাতার সোভিয়েত আক্রমণে প্রকম্পিত হত জাতিগতভাবে তাজিকদের বাসভূমি আফগানিস্তানের পাঞ্জশির ভ্যালি। সোভিয়েত বিরোধী কিংবদন্তি এবং পরবর্তীতে তালেবান বিরোধী কমান্ডার আহমদ শাহ মাসউদ পাঞ্জশিরে করা প্রতিটি আক্রমণ নস্যাৎ করে দিতেন।

মাসউদের প্রতিরোধ এতই দৃঢ় ছিল যে, ৯/১১ হামলার কয়েকদিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা তালেবানদের সাথে জোট করে তাকে হত্যা করার জন্য দুটি বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পর ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করতে পাঞ্জশিরে একটি ছোট সিআইএ বাহিনী পাঠিয়েছিল মাসুদের কমরেডদের সাথে আঁতাত করার জন্য।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে জ্যেষ্ঠ মাসউদের সাবেক সহযোগী ও প্রাক্তন সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহর সাথে উপত্যকাটিতে লুকিয়ে লড়াইরত মাসুদের ৩২ বছর বয়সী পুত্র আহমদ মাসউদের পরাজয় ঘটে। ৫ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার তালেবান সৈন্য উপত্যকাটি ঘিরে ফেলে এবং হামলা চালায়। উপায়ন্তর না দেখে মাসুদ যুদ্ধবিরতি এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য আলোচনার আহ্বান জানান। কিন্তু রাজি হয়নি তালেবানরা।

পাঞ্জশিরের কারণে ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আক্রমণের পর থেকে কোনো শক্তিই আফগানিস্তানের ওপর সম্পূর্ণ দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাই দুর্গম ও দুর্জেয় পাঞ্জশিরে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
এরপর, ৭ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল এবং আলেমদের নিয়ে তালেবনারা যে ৩৩ জনের শক্তিশালী অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার গঠন করেছে, সেটির চোহারা পুরনো তালেবানের মতোই। চিরাচরিতভাবে এতে কোনও মহিলা নেই। তবে, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দলটি অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দিয়েছে এবং বেশিরভাগ অ-পশতুনদের বাদ দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এবং যদিও তালেবানরা বলেছিল যে, তারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার চায়, কিন্তু পাঞ্জশিরে তাদের সহিংস বিজয় এটিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের থিংক ট্যাঙ্ক ইব্রাহিম বাহিস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘এটি কেবল তাজিকদেরই নয়, হাজারাদের মতো অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরও প্রভাবিত করতে পারে।’

ইতোমধ্যে, তালেবানের অন্তর্গত অনেক পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের দল, যাদের পাঞ্জশির আক্রমণে বড় ভূমিকা রয়েছে, তারা দক্ষিণ প্রদেশে, বিশেষত হেলমান্দে তালিবানদের আধিপত্যে বিরক্ত। যদি তালেবানের মধ্যে দলীয় রাজনীতি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ঘরোয়া রাজনীতি কঠিনতর হয়ে উঠবে।

যেহেতু তালেবানরা এখন আর সম্পূর্ণভাবে পশতুন শাসিত নয় এবং তাদের দলে কিছু তাজিক ও উজবেক রয়েছে, সেই জাতিগোষ্ঠীর কিছু জ্যেষ্ঠ অ-তালেবান ব্যক্তিত্ব এখন নতুন সরকারে যোগদান করতে পারেন বা তারা তালেবানের সার্বিক আধিপত্যকে খর্ব করে দেয়ার জন্য একজোট হতে পারেন।

এদিকে, নতুন তালেবান সরকার গঠনের পর থেকে সরকারি মন্ত্রণালয়ের বাইরে রাস্তাঘাট স্বাভাবিকের চেয়ে শান্ত এবং বহু দোকান বন্ধ। যদিও মহিলাদের এখনও দেখা যায়, তবে তাদের সংখ্যা আগের তুলনায় কম। কাবুলের একদা সরগরম ক্লাউড ক্যাফের টেবিলগুলো মূলত নির্জন। সেখানকার এক সদস্য বলেছেন, অর্থনৈতিক সঙ্কট তাদের ব্যবসাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কিন্তু কট্টরপন্থী তালেবানদের এমন একটি সরকারের আন্তর্জাতিক দাতাদের সন্তুষ্ট করার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে, যারা দেশটির অর্থনৈতিক বিপর্যয় লাঘব করতে পারে।

আফগানিস্তানের জনস্বাস্থ্যের প্রধান ড. ওয়াহিদ মাজরুহ প্রাক্তন সরকারের একমাত্র মন্ত্রী যিনি কাবুল পতনের সময় তার পদে আসীন ছিলেন। প্রস্থানের সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিচালনা করার জন্য রয়ে গেছেন তিনি। বিদেশী সাহায্য স্থগিত হওয়ার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে তিনি হতাশ।
ড. মাজরুহ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক দাতারা হাজার হাজার ক্লিনিক এবং হাসপাতালের জন্য প্রদত্ত অনুদান স্থগিত করেছে। সরবরাহ ও ওষুধের অভাবে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তিনি কর্মীদের মুখোমুখি হন যারা বলে তারা অভুক্ত। মাজরুহ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘সিস্টেমটি ভেঙে পড়বে যদি দাতারা আরো নমনীয় হতে না পারে এবং অনুদান আবার চালু করার উপায় খুঁজে না পায়।’

অন্যদিকে, কাবুল দখলের ৩ সপ্তাহের মধ্যেই তালেবানরা যে বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে, যা তাদের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের ৫ বছরের শাসনকালের তুলনায় অনকে বেশি। ৪ সেপ্টেম্বর তারা কাবুলে আফগান মহিলাদের একটি বিক্ষোভকে সহিংসভাবে নস্যাৎ করে দেয়। পশ্চিমে হেরাত ও ফারাহ এবং উত্তরে বাল্খ এবং মাজার-ই-শরীফে একই ধরনের বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে তারা।

বাহিস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে যদি তালেবানরা জাতিগত উত্তেজনা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাবো দেশে উত্তেজনা বাড়ছে, যার প্রকৃত সম্ভাবনা রয়েছে যে, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।’

বড় বিজয় বড় দায়িত্ব নিয়ে আসে। যদি নতুন তালেবান সরকার আফগাানস্তানের তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতি, বিপর্যস্ত অবকাঠামো, দেশটির গোষ্ঠি ও জাতিগত সঙ্ঘাত সমাধানের সহনশীল ও কার্যকরী ভূমিকা না নেয় তাহলে আবারও শোচনীয় পতন ঘটবে তাদের এবং দেশটির আরও একটি দীর্ঘ ধ্বংসযজ্ঞ অবলোকন করবে বিশ্ব। সূত্র : দ্য ইকোনোমিস্ট, ট্রিবিউন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স।



 

Show all comments
  • Mohammad Roni ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৪৯ এএম says : 0
    আফগানিস্তান নিয়ে আপনাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Jalal Ahmed ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫০ এএম says : 1
    বিগত 20 বছর আমেরিকানদের অত্যাচার জুলুম চলেছে তখন তোরা কোথায় ছিলি
    Total Reply(0) Reply
  • Biplob Mahbub ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫১ এএম says : 0
    আফগান নারীদের দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে আফগান সরকার বিশেষভাবে আহবান জানাচ্ছে...
    Total Reply(0) Reply
  • Sujon Mahmud ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
    পশ্চিমা বিশ্ব আর আমাদের দেশের কিছু নারী বাদিরা খালি নারীদের কি ভাবে রাস্তায় নামানো যায়,আর তাদের হালাল করা যায় সেটা নিয়াই তাদের কল্পনা জল্পনা
    Total Reply(0) Reply
  • Abdullah Bepul ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
    মহান আল্লাহ তাদের সৎ উদ্দেশ্য গুলো কে কবুল করে নিন আর দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করুক শয়তান নিপাত যাক আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের আইন বিজয়ী হোক দোয়া ও শুভকামনা রইল তাদের জন্য?
    Total Reply(0) Reply
  • Sk Rashel ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
    বিশ বছর পুরা দেশটা দখল করে রাখছে, কত নিরিহ মানুষ মরেছে।,তখন কোথায় ছিলো তুদের মানবতা,
    Total Reply(1) Reply
    • Azizur Rahman ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৬:৫৩ এএম says : 0
      The general Amnesty is an example. Taleban may proceed on the basis of Islamic rule i.e. Justice, equality and tranquility. Avoid the western culture and theolog. As soon as possible rebuild Army Navy and Air Force and collect up to date Arms and ammunition. Though Afghanistan is a Land locked country Try to build a Navy in the Deep Sea.
  • মোঃ ইব্রাহীম মোঃ ইব্রাহীম খলিল ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১:৪১ এএম says : 0
    তালেবান সবেমাত্র সরকার গঠন করছে, তাদেরকে চলতে দেওয়া হোক। চলার আগেই যদি কুমন্তব্য করা হয়। তাহলে পরে কি করবে। রিজিক তো আমেরিকার হাতে নয়। রিজিক তো আল্লাহর কাছে। রিজিক আল্লাহ জমিন থেকে দিবেন, সে রিজিক খেয়ে মানুষ বাচবে। আর আমেরিকার কাছে আছে বোমা যাহা দিয়ে মানুষকে মারবে।
    Total Reply(0) Reply
  • গাজি মুহাম্মাদ সফিক ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:৪৫ এএম says : 0
    আল্লাহর রহমতে তালিবানরা সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনা করবেন।কারন মহান আল্লাহর রহমত না হলে,লক্ষ লক্ষ সেনাদের বিরুদ্ধে মাত্র ৬৫ হাজার তালিবান সৈন্য কি করে বিজিত হলেন?
    Total Reply(0) Reply
  • সবুজ ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৮ এএম says : 0
    গত 20 বছরে যত অন্যায় অবিচার জুলুম অত্যাচার হয়েছে সেগুলোর উল্লেখ নাই কেন? পশ্চিমাদের গোলামী আর নারীদের নির্লজ্জের মত রাস্তায় নামানো ও আফগানদের সম্পদ রুট করার নাম ই কি মানবতা? গত 20 বছর যাবৎ বলা হচ্ছিল আফিম চাষ করে তালেবানরা অর্থনীতির যোগান দেয়। অথচ এখন আমরা খবরে দেখি তালেবান ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে আফিন চাষ বন্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশনা এসেছে? এই মিথ্যাচার আর কতদিন চলবে?
    Total Reply(0) Reply
  • হাসান সোহাগ ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৯:১৯ এএম says : 0
    আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। তবে আমি মনে করি না সেরকম কিছু হবে
    Total Reply(0) Reply
  • আমিক ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৯:৫৯ এএম says : 0
    বহু তত্ত্ব বিদ্যা আর পণ্ডিতি করা হয়েছে। সকল পণ্ডিতের পণ্ডিতি ব্যর্থ করে দিয়ে তালেবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এখনো পণ্ডিতি চলছে সমানে। আহমেদ মাসুদকে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল তালেবানরা শুরুর দিকে কিন্তু সে অহং এর ঠেলায় তা মানেনি, ত্যাড়া শর্ত চাপিয়েছিল। এখন রক্তপাত ঘটানোর পরে ঠেলায় পড়ে সে শান্তি আলোচনার কথা বলছে। রক্তপাত ঘটানোর পর তার শান্তি প্রস্তাবে তালিবানদের আগ্রহের কোন কারন আমি দেখিনা।
    Total Reply(0) Reply
  • Abu ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:০৭ এএম says : 0
    আপনারা তো বিশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন আফিম চাষ বন্ধ করতে পারেননি কেন?
    Total Reply(0) Reply
  • Md Azadul Islam ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৯:১০ পিএম says : 0
    আফগান ৯৯.৭% মুসলমানদের দেশ, সেখানে মুসলিম শরিয়া আইন চলাতে অন্যদের এত মাথা ব্যাথা কেন? আচ্ছা আপনারা যারা এত কিছু দেখছেন, বলেন তো গত বিশ বছরে আমেরিকান দের কোন নির্যাতন দেখেছেন? আর গত বিশ বছরে আফগানের কোন উন্নতি হলো না কেন?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ