দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মহান আল্লাহর হুকুমে হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙা ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামত সংঘটিত হবে। ধ্বংস হবে নশ্বর এ পৃথিবী। মৃত্যু হবে পৃথিবীর সবকিছুর। আল্লাহর নির্দেশে তাঁর দ্বিতীয়বার ফুৎকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংঘটিত হবে পুনরুত্থান। শুরু হবে কবর থেকে উঠার পালা। হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর দুই ফুৎকারের মাঝে সময়ের ব্যবধান কত হবে এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুই ফুৎকারের মাঝের সময়ের পরিমাণ হলো চল্লিশ। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আবু হুরাইরা, ইহা কি চল্লিশ দিন? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ বছর? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। অতঃপর আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন তখন মানুষ উদ্ভিদের ন্যায় বের হতে থাকবে। মানুষের পশ্চাদাংশের পুচ্ছের একটি হাড় ছাড়া সমস্ত শরীর ক্ষয় হয়ে যাবে। আর তা থেকেই আবার কিয়ামতের দিন মানুষকে সৃষ্টি করা হবে।’ (বুখারি : ৪৯৩৫)।
মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিশ্বাস রাখা ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয়। মৃত্যু যেমন সত্য। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ঠিক এমন সত্য। মহান আল্লাহ স্বীয় কুদরত ব্যবহার করে ছিন্ন-বিছিন্ন মৃত সব শরীর একত্র করবেন। পৃথিবীতে কাউকে বাঘে খেয়ে ফেললে, পানিতে ডুবে মরলে, আগুনে পুড়ে মরলে বাহ্যত দেখা যায় এর কিছুই থাকে না। কিন্তু এ সবকিছুর পুনরুত্থান ঘটাবেন মহান আল্লাহ। অতঃপর এগুলোতে তিনি রুহ ফিরিয়ে দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘শিঙায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ফলে যাদেরকে আল্লাহ ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকলে মূর্ছিত হয়ে পড়বে। অতঃপর আবার শিঙায় ফুৎকার দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে।’ (সুরা জুমার : ৬৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ সত্য এবং তিনিই মৃতকে জীবন দান করেন এবং তিনি সব বিষয়ে শক্তিমান, এবং কিয়ামত আসিবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং কবরে যারা আছে তাদের নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্থিত করবেন।’ (সুরা হজ : ৬-৭)।
মৃত শুষ্ক জমিন যেভাবে বৃষ্টির মাধ্যমে সবুজ-শ্যামল হয়ে প্রাণ ফিরে পায়। ঠিক সেভাবে মৃত মানুষেরাও জীবিত হয়ে উত্থিত হবে। কোরআনের ভাষ্য, ‘তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই। অতঃপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সবধরণের ফল উৎপন্ন করি। এমনিভাবে মৃতদের বের করব। যাতে তোমরা স্মরণ কর।’ (সুরা আ‘রাফ : ৫৭)।
কাফেররা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত। একে অসম্ভব মনে করত। তারা মনে করত, একটা প্রাণী পচেঁ-গলে যাওয়ার পর, হাড্ডি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সেটি আবার কিভাবে জীবিত হবে? তারা বুঝতে চাইত না যে, এটি প্রথমবারও সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কাফেররা ধারণা করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। বল, ‘নিশ্চয় হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ! তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদের সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা তাগাবুন : ৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তারা বলে, আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণবিচূর্ণ হলেও কি নতুনরূপে উত্থিত হব? বলে দাও, তোমরা হয়ে যাও পাথর বা লোহা অথবা এমন কিছু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন, তারা বলবে, কে আমাদের পুনরুত্থিত করবে? বলে দাও, তিনিই, যিনি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তারা তোমার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, তা কবে? বল, সম্ভবত তা শিগগিরই হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৪৯-৫১)।
পুনরুত্থানপর্বে সর্বপ্রথম যে কবরটি ফেটে যাবে সেটি হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা.)-এর কবর। হাদিসে এসেছে, ‘কিয়ামত দিবসে মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং সর্বাগ্রে আমার (কবরের) জমিন ফেটে যাবে।’ (বুখারি : ২৪১২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কিয়ামত দিবসে মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং আমি সর্বপ্রথম জ্ঞান ফিরে পাব।’ (২৪১২)।
পুনরুত্থান কিয়ামতের কঠিন একটি ধাপ। মানুষ ও জিন জাতির জন্য পুনরুত্থান হবে অনেক ভয় ও উৎকণ্ঠার। নবী-রাসুলরাও সেদিন ইয়া নাফসি (আমার কী অবস্থা হবে) ইয়া নাফসি (আমার কী অবস্থা হবে) বলতে থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন শিঙায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখনই তারা কবর হতে ছুটে আসবে তাদের প্রতিপালকের দিকে। তারা বলবে, ‘হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠাল? দয়াময় আল্লাহ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসুলরা সত্যই বলেছিলেন। এটা হবে কেবল এক মহানাদ; তখনই তাদের সবাইকে উপস্থিত করা হবে আমার সামনে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৫১-৫৩)। অনেক মানুষ সেদিন বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায় উত্থিত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘অপমানে অবনমিত নেত্রে তারা কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়, তারা আহবানকারীর দিকে ছুটে আসবে ভীত-বিহবল হয়ে। কাফেররা বলবে, কঠিন এই দিন।’ (সুরা কামার : ৭-৮)। গ্রীষ্মকালে অনেক সময় দেখা যায় মাটি ফুঁড়ে পোকা-মাকড় বের হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে, পুনরুত্থানের সময় মানুষেরও তেমনি অবস্থা হবে। মাটি ফেঁড়ে তারা বের হতে থাকবে।
নিতান্ত অসহায়-নিঃস্ব হয়ে সেদিন সবাইকে পুনরুত্থিত হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমরা নগ্নপদে, বস্ত্রহীন ও খৎনাবিহীন অবস্থায় উত্থিত হবে।’ (মুসলিম : ২৮৬০)। প্রত্যেকে যে অবস্থায় ইন্তেকাল করবে সে সে অবস্থায় উঠবে। যে শহীদ হয়ে মরেছে সে শহীদ হয়ে উঠবে। যে হজব্রত পালন অবস্থায় মারা গেছে, সে হাজী হয়ে উঠবে।
পুনরুত্থান যেদিন শুরু হবে সেদিন হবে শুক্রবার। হজরত আওস ইবনে আওস সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় তোমাদের শ্রেষ্ঠ দিবস হলো শুক্রবার দিন। এ দিনেই (প্রথম শিঙায় ফুৎকারের ফলে) সবকিছু অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং এ দিনেই দ্বিতীয় শিঙায় ফুৎকার হবে।’ (নাসায়ি : ১৩৭৩)।
লেখক : শিক্ষক, হাদীস ও ফাতেয়া বিভাগ, দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়াণগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।