Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

‘সত্যভাষী’ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ড. আকবর আলি খানের দাফন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

অর্থনীতিবিদ-শিক্ষাবিদ-গবেষক-মুক্তিযোদ্ধা-কলমযোদ্ধা-কণ্ঠযোদ্ধা-সৎ-সত্যভাষী-সাহসী-জনমুখি চিন্তক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। দেশের যে ক’জন বুদ্ধিজীবী-সাবেক আমলা ব্যাক্তিগত সুবিধায় আদায়ে বিবেক বিক্রি হননি এবং অন্যায়-অবিচার দেখেও বধির থাকেননি; তাদের অন্যতম ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান। দেশের অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। বুদ্ধিজীবী মহলের বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত সেই ড. আকবর আলি খানকে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার তাকে সেখানে দাফন করা হয়। তার আগে বাদ জুমা রাজধানীর গুলশানে আজাদ মসজিদে তার জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। জানাজায় অংশ নিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানসহ দেশের বরেণ্য ব্যাক্তি, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা। জানাজা শেষে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

এর আগে গতকাল সকালে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে তার লাশ গুলশান-১ এর বাসায় নেয়া হয়। সেখানে সকাল থেকেই স্বজন ও বিশিষ্টজনেরা লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্রদ্ধা জানাতে গুলশানে আকবর আলি খানের বাসায় বরেণ্য ব্যাক্তিরা উপস্থিত হন। তারা স্মৃতি রোমন্থন করে জানান, আকবর আলি খান তার কাজ আর লেখনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। তিনি সব সময় যে সত্য লিখেছেন। তার লেখনীর মাধ্যমে জাতি তাকে স্মরণ রাখবে। কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন তিনি মানুষের হৃদয়ে। তার স্বজনরা বলেন, পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে আকবর আলি খানের সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল। দীর্ঘদিন তিনি একা ছিলেন। স্ত্রীকে হারিয়ে বয়স্ক শাশুড়িকে তিনি দেখাশুনা করেছেন।

ড. আকবর আলি খান ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে সম্মান ও ১৯৬৫ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন, দুটিতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। মেধাবী শিক্ষার্থী আকবর আলি খান পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং পিএইচডি করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭০ সালে হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও) হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেন। নিজ হাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ জোগান দেয়ার আদেশ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য জোগান দেয়ার জন্য গুদামঘর খুলে দেন এবং পরবর্তী সময়ে আগরতলায় চলে যান। এরপর সহযোগীদের নিয়ে তিনি একটি পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, যার লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি উদ্বাস্তু শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিল সেই শরণার্থীদের সহায়তা করা। এ ‘অপরাধে’ যুদ্ধ চলাকালেই তার বিচার করে পাকিস্তান সরকার, দেয়া হয় ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে আকবর আলি খান সচিবালয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তিনি সেখানে ৬ মাস চাকরি করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান থেকে ফেরত ব্যক্তিদের চাকরি পেতে সহায়তা করেন। পরে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত হবার আগে তিনি অল্প সময়ের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বৃত্তির জন্য তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সেখানে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স এবং পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরত আসার পরে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাকে আবারো প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানানো হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি সাভারের বিপিএটিসি-তে মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ (এমডিএস) হিসেবে যোগ দেন। অতঃপর ১৯৮৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ে কাজ করেন। তিনি ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে মিনিস্টার (ইকনমিক) পদে যোগ দেন। ঢাকায় ফিরে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদে যোগ দেন। অল্প সময়ের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে কাজ করে তিনি ১৯৯৩ এ সরকারের সচিব হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অর্থ সচিব হিসাবে পদস্থ হন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে কাজ করেন। ২০০১ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক (অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর) পদে যোগদান করেন। বিশ্ব ব্যাংকে তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। আকবর আলি খান রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি অধ্যাপনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।২০০৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। পরে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না Ñএমন শঙ্কায় যে ৩ জন উপদেষ্টা একযোগে পদত্যাগ করেন তিনি তাদের একজন।

গবেষক হিসেবে ড. আকবর আলি খান প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার প্রকাশিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৭টি। তার লেখা জনপ্রিয় প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’, ‘স্বার্থপরতার অর্থনীতি’, ‘আজব ও জবর আজব অর্থনীতি’, ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’, ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’, ‘ডিসকভারি অব বাংলাদেশ’, ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস’, ‘হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার অ্যান্ড আদার এসেস’, ‘গ্রেশাম’স ল সিন্ড্রম অ্যান্ড বিঅন্ড’, ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’, ‘চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন’ এবং আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ ইত্যাদি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ড. আকবর আলি খান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ