Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এ অবস্থা কখনোই কাম্য হতে পারে না

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

সম্প্রতি শাসক দলের ব্যানার অপসারণকে ঘিরে সৃষ্ট ঘটনায় বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা চালায় মহানগর আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় সদর উপজেলা প্রাঙ্গন রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। ইউএনওকে রক্ষা এবং তারই নির্দেশে আনসার ও পুলিশের গুলিতে ওসি নিজে দুই পুলিশ সদস্য এবং প্যানেল মেয়রসহ সাতজন আহত হন। অপরদিকে পুলিশের লাটিচার্জে অপরপক্ষের আরো প্রায় ৩০ জন আহত হয় বলে খবরে প্রকাশ।
এ ঘটনায় পরদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বরিশালের বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, সারা নগর জুড়ে বিরাজ করে থমথমে অবস্থা। দুপুরে পুলিশের দায়েরকৃত দুই মামলায় মেয়র সাদিকসহ কয়েকশত জনকে আসামি করা হয়। আওয়ামী লীগের বেশ ক’জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট ১০ প্লাটুন বিজিবি এবং ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাওয়া হয়। এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে ইউএনও বলেন প্রতিমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত শোক দিবসের ব্যানার অপসারণ করতে বুধবার রাতে বিসিবির লোকজন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে তাদেরকে পরদিন সকালে আসার অনুরোধ জানানো হয়। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পরবর্তী পর্যায়ে ৬০-৭০ জনের একটি দল ইউএনও’র সরকারি বাসভবনের দিকে আসতে থাকলে কর্তব্যরত আনসাররা বিষয়টি ইউএনওকে অবহিত করেন। ইউএনও ২-তলা থেকে নিচে নেমে এলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিবসহ কয়েকজন বাসায় প্রবেশ করে এবং ইউএনওকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তাকে ঘিরে ধরে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সরকারি সম্পদ ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য আনসারদের সাহায্যে চান ইউএনও। আনসাররা অবস্থা বেগতিক দেখে এবং জানমালের নিরাপত্তা বিধানে গুলি ছুঁড়লে আন্দোলনকারীরা সবাই ফিরে যেতে বাধ্য হয়। যাওয়ার সময় তারা বাসার প্রধান গেইট ভাঙচুর করে এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এরপর থেকেই চলে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। প্রশাসনিক ক্যাডারের পক্ষ থেকে মেয়রকে গ্রেফতারের দাবিও করা হয়। আবার আওয়ামী লীগ বা বিসিবির পক্ষ থেকে চলে মিটিং, মিছিল, মানববন্ধনসহ পাল্টা অভিযোগ। যে যাই করুক আর বলুক, এটা দেশের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয় মোটেই। কঠিন পরিস্থিতিতে সকল পক্ষেরই দেশের স্বার্থে সংযমী এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। মিটিং-মিছিলে ভাঙচুর করে বা গুলি ছুঁড়ে সম্পত্তি নষ্ট করে সমস্যার সমাধান না করে ধৈর্য্য ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকলে দেখা দেয় বিশৃংখলা, সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নেয় আর দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য আমাদের দেশে মাঝে-মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটে থাকে, যার ফলে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। এটা কিন্তু কোনভাবেই কাম্য নয়।
এদিকে মাসখানেক আগে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্য একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যাতে বাংলাদেশ বিমানের বা সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। বিলাত প্রবাসী জামিলা চৌধুরী নির্ধারিত সময়ের ৩ ঘণ্টা পূর্বে বিমানবন্দরে পৌঁছালেও তিনি নির্ধারিত ফ্লাইটে লন্ডনে ফেরত যেতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, যাত্রী জামিলা চৌধুরীর লাগেজের ওজন নির্ধারিত ওজনের চেয়ে কিছু বেশি ছিল, কিন্তু বিমানবন্দরে কর্মরত লোকজন যাত্রীর নিকট বাড়তি মালামাল ওজনের জন্য অতিরিক্ত ২৬ হাজার টাকা দাবি করেন। যাত্রী মহিলা তার কাছে বাড়তি টাকা না থাকায় তিনি বাড়তি মালামাল রেখে একটি লাগেজ নিয়েই লন্ডন ফেরত যেতে চান। কিন্তু নানা অজুহাতে মহিলাকে নাজেহাল করা হয় এবং সময় নষ্ট করে তিনি যাতে ঐ ফ্লাইটে লন্ডনে যেতে না পারেন সে পরিবেশও সৃষ্টি করা হয়। ভদ্রমহিলা বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্তরে এমনকি স্টেশন ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি বরং বিমানের কাউন্টারের কর্মরত কর্মকর্তা যাত্রী মহিলার মুখে পাসপোর্ট ছুঁড়ে দিয়ে তাকে পাগল বলেও মন্তব্য করেন। ভদ্রমহিলার আট বছর বয়সের ছেলে লন্ডনে অসুস্থ। সে মাকে দেখার জন্য কান্নাকাটি করছে, এসব জানানোর পরও যাত্রীকে বিমানে আরোহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। এ নিয়ে সারা দেশে এমনকি সুদূর লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের এ ঘটনার লন্ডনে মানববন্ধন, প্রেস কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিবাদ এবং দোষী বিমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়। কিছু অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জন্য বাংলাদেশ বিমানের ভাবমর্যাদা নষ্ট হোক এটাতো আমাদের কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করবো, বিমান কর্তৃপক্ষ যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, সুষ্ঠু তদন্তের পর দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চত করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আমরা জানি, দেশে ক্ষমতায় একটি সরকার রয়েছে। তার অধীনে রয়েছে অনেকগুলো মন্ত্রণালয়, রয়েছেন নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন বাহিনী। তারপরও কেন এমন সব ঘটনা চলেছে, যাতে সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা। আমরা বুঝে উঠতে পারছি না, এভাবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ কী? কেন আজ কিছু মানুষ অমানুষের মতো অপরাধ করে চলেছে। দেশে একটা সরকার থাকার পরও কেন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টির চেষ্টা চলছে? মানুষ নামের এসব দুর্বত্ত-দুরাচারীর দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তির ব্যবস্থা কি করা যায় না? মারাত্মক এ জাতীয় অপরাধের ঘটনা রাজধানী ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া প্রমাণ করে, দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। দেশের এ হাল-অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের জানমালের নিরাপত্তাজনিত কারণে অসহায় ও বোবা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের জনসাধারণ নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকিত অবস্থায় দিন গোজরান করছে। এ নিয়ে প্রশাসন, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন মাথা ব্যাথা আছে বলে মনে হয় না। তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না বলে সাধারণ মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিজেরটা হয়ে গেলে অন্যদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা বুঝতেই চায় না যে, তাদের দায়িত্ব কী? কেন তাদের বেতন, ভাতাসহ আনুষঙ্গিক অনেক-বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে জনগণের করের টাকা হতে? অপরাধ বাড়ছে, অপরাধী সর্বদাই সক্রিয় রয়েছে। আবার এসব অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তারা, যাদের দায়িত্ব অপরাধ প্রতিহত করা, অপরাধীদের দমন করা। এ অভিযোগ প্রায় সর্বত্রই। অপরাধ প্রবণতা এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কে কখন কীভাবে আক্রান্ত হবে, কার সম্পত্তি কে দখল করবে, কে কখন লাঞ্চিত হবে, কে কখন অপহৃত হবে এ আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের চোখে ঘুম নেই। এ অপরাধ প্রবণতা রোধে কেউই সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসছে না। সবাই যেন নীরব দর্শক।
আবার অপরাধী, দুষ্কৃতকারী, সস্ত্রাসী, খুনীদের কোন কোন সময় গ্রেফতার করা হলে প্রতিবাদ, মিছিল, সভা হয়, বিবৃতি প্রদান করা হয়- এটাও ঠিক। অপরাধীরা ঘৃণার পরিবর্তে আশ্রয়প্রাপ্ত ও উৎসাহিত হয়। দলীয় গোষ্ঠিস্বার্থকে সর্বত্র অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি কারাগার পর্যন্ত এখন আর কেউই নিরাপদ নয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে মারপিট করে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে শুধু ভয় দেখানো হচ্ছে না খুনও করা হচ্ছে। সাগর-রুনি তার একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়, আরো আছে। পরিস্থিতির অবনতির এর চেয়ে ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে, পুলিশ বিভাগের বড় কর্তাদের অফিস ও বাসার সামনে চলছে মদ, জুয়া, ছেঁড়া টাকা, পাউন্ড-ডলারের অবৈধ ব্যবসা, পতিতারা অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে দেহ ব্যবসা, নেই কোনো প্রতিকার, নেই প্রতিরোধ। আছে আইন, নেই প্রয়োগ ।
দেশের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা জনিত স্বাভাবিক পরিবেশ ও সুষ্ঠু পরিস্থিতি। অথচ, সেরূপ পরিস্থিতির নিশ্চয়তার জন্য প্রচেষ্টা কি চালানো হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তবে ফলাফল কোথায়? আসলে আমরা মুখে যা বলি কার্যক্ষেত্রে তাতে বিশ্বাসী নই। দেশের জনগণকে সকল শক্তির- সকল ক্ষমতার উৎস বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু তারা রাজনৈতিক প্রত্যয় ও অঙ্গিকারে বলিয়ান নয়। তারা লোভী, ভোগ ও সুবিধাবাদী। এ সুবিধাবাদের কারণে তারা দল বদল করে, লেবাস পরিবর্তন করে। তারা অপরাধ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে থাকে। জুলুম ও জালেমকে যেখানে আমাদের ঘৃণা করা উচিত, সেখানে আমরা কেবল নীরবই থাকি না তাদের পক্ষে কথা বলি, নিরপরাধ বলে বিবৃতি, বক্তৃতা দিয়ে থাকি। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর শাস্তির কঠোর বিধানই সন্ত্রাসের একমাত্র জবাব।
পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ করে ব্যবস্থা গ্রহণে সময়ক্ষেপণ করা হলে অবনতি দ্রুত হয়। প্রতিপক্ষ দুঃসাহসী ও শক্তিশালী হয়, পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পরিস্থিতিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। জনগণকে একসময় যতই অসহায় মনে করা হোক না কেন, জনগণই ক্ষমতার উৎস। জনগণের শক্তি অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে যে নৈরাজ্য নেমে আসে তা কারো জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, ইতিহাস এর সাক্ষী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন