Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

পাট খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৪ এএম

পাট ও পাটজাতপণ্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রফতানি পণ্য। উপনিবেশোত্তর কালে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের প্রধান পণ্য ও প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে দেশের শিল্প ও কৃষিতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল পাটের। দেশের লাখ লাখ কৃষক, লাখ লাখ পাটকল শ্রমিক এবং এর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতে লাখ লাখ মানুষের সম্পৃক্ততায় পাটখাত হয়ে উঠেছিল দেশের জাতীয় অর্থনীতির মূল শক্তি। বিশ্বপরিমন্ডলে গোল্ডেন ফাইবার বা সোনালি আঁশ খ্যাত পাটশিল্প ধ্বংসের আয়োজন শুরু হয় ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর। সে সময় একের পর এক রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলের গুদামে আগুন লেগে হাজার হাজার বেল পাট পুড়ে যেতে থাকে, পাটকলগুলো শ্রমিক অসন্তোষ, আন্দোলন, সহিংসতা ও লুটপাটের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একসময়ের লাভজনক পাটকলের উৎপাদনশীলতায় ঘাটতি ও লোকসানের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল। অথচ, একই সময়ে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন পাটকল গড়ে উঠতে দেখা যায়। একদিকে বাংলাদেশের পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে অন্যদিকে ভারতে নতুন নতুন পাটকল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত উন্নতমানের কাঁচা পাট আমদানি করে সেদেশের পাটকলগুলো চালু রাখার পদক্ষেপ নিয়েছিল ভারত সরকার। এভাবেই পাটশিল্পের বিশ্ববাণিজ্যের নেতৃত্ব বাংলাদেশের হাত থেকে ভারতের হাতে চলে যায়।

বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী দেশের সংখ্যা হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র। এদের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো এগিয়ে। পাটপণ্যের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বাজার কখনো এমন অবস্থায় উপনীত হয়নি, যে কারণে বাংলাদেশের পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে সিনথেটিক পণ্যের বিপরীতে পাটের মতো প্রাকৃতিক তন্তুজাত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গত দুই দশক ধরে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকলের বেশিরভাগ এখনো লাভজনকভাবে টিকে আছে। তবে বিপুল পরিমাণ জমিসহ স্থাবর সম্পদ নিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদনশীলতা নিম্নমুখী হওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি-অপচয়ের কারণে বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখেই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ২০০২ সালে বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয় তৎকালীন বিএনপি সরকার। সে সময় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তবে রাষ্ট্রায়াত্ত অন্যান্য পাটকল বন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি সরকার। আদমজী পাটকল বন্ধের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ অনেক রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি পাটখাতকে লাভজনক করা এবং পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অতীতে কোনো সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করেনি, গতবছর করোনা মহামারির সময় দেশের ২৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকল বন্ধের মধ্য দিয়ে দেশের পাটশিল্পের জন্য এ যাবৎকালের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

বৈশ্বিক বাস্তবতায় অনেক সম্ভাবনাময় পাটশিল্প নিয়ে সরকার যখন বিপরীতমুখী অবস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনি পাটখাতের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল। ধারণা করা হয়, সরকারের অভ্যন্তরে থাকা ভারতপন্থী আমলাদের প্রভাবে সরকার পাটখাতের আধুনিকায়নে চীনের প্রস্তাব নিয়ে সময়ক্ষেপণের নীতি গ্রহণ করে। সম্ভাবনাময় আরো অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাবের মতো পাটখাতে চীনের সময়োপযোগী প্রস্তাবটি নিয়ে সরকারকে শীতল ভূমিকায় দেখা গেছে। এবার পাটকলে সউদী বিনিয়োগের প্রস্তাব পাওয়া গেল। দেশের যে কোনো খাতে সউদী বিনিয়োগ ইতিবাচক। তবে পাটখাতের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ প্রস্তাবকেই বেশি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। পাটশিল্পে সউদী বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেলেও তা এখনো যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। সউদী রাষ্ট্রদূত বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার দেশের আগ্রহের কথা বলেছেন। পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব এলে বোঝা যাবে, তা কতটা অনুকূল ও ফলপ্রসূ হবে। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তবতায় অর্থনৈতিকভাবে সফল ও সম্ভাবনাময় প্রস্তাবকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে। এ সংক্রান্ত চীনা প্রস্তাবও বিবেচনার দাবি রাখে। পাটখাতের উন্নয়নে চীন ও সউদী প্রস্তাব আমলে নিয়ে যে কোনোটি অথবা উভয় প্রস্তাব গ্রহণ করে দ্রুত তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। পাটখাতের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনী প্রতিভাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগকেই প্রাধান্য দিতে হবে। পাটশিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন থেকে শুরু করে শ্রমিক, বিনিয়োগ ও রফতানি বাণিজ্যের পুরোটাই আমাদের নিজস্ব সম্পদ ও অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত। গার্মেন্ট বা অন্যকোনো রফতানিমুখী শিল্পে এমন আত্মনির্ভরতার উদাহরণ নেই। এ কারণে বিনিয়োগ ও পরিবেশগত সুরক্ষার দিক থেকে পাটশিল্প তুলনামূলকভাবে অধিক সম্ভাবনাময়। পাটখাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও পাটের সোনালি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন