Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর: অবদান অশেষ ও অবিস্মরণীয়

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৬ এএম

‘জাতি হিসাবে মুসলমানদেরও একটা নিজস্ব ও অনন্য নিরপেক্ষ সংস্কৃতি আছে। দীর্ঘকালের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কারের ইতিহাসে নানা সুখ-দুঃখ পূর্ণ স্মৃতির মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্য সেবার অভিনব রূপ রসের অনুভূতি ও আস্বাদের মধ্য দিয়ে অতীতের বহু সঞ্চয় ও ভবিষ্যতের বহু সম্ভাবনাকে অবলম্বন করিয়া মুসলমানের এই সংস্কৃতি সৃষ্ট পুষ্ট ও জীবন্ত হইয়া আছে।’

বৃটিশ শাসন আমলে কোলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সংস্কৃতিক শাখার সভাপতির ভাষণে মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ মুসলমানদের সংস্কৃতির রূপ কেমন হবে তার ব্যাখা দিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর এ কথামালায় সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই।

মুসলিম বাংলার গণজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮৬৯ মতান্তরে ১৮৬৮ সালে ৭ জুন চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী আলিম ও মুজাহিদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা আকরম খাঁর পিতা মওলানা আবদুল বারী এবং পিতামহ তোরাব আলী। পিতা ছিলেন খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবদি এবং কামিল পীর। পিতামহ ছিলেন ওহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী শৈশবকালেই আকরম খাঁকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করা হয়। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী আকরম খাঁ অল্প দিনের মধ্যেই পবিত্র কোরআন শরীফ ও বিখ্যাত ফার্সি কাব্যগ্রন্থ ‘গুলিস্তা’, ‘বুস্তার’ পাঠ সমাপ্ত করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য পিতার সঙ্গে তিনি কলিকাতা যান এবং জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন। অসুস্থ হওয়ার ফলে কলিকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। আকরাম খাঁ বয়স যখন এগার তখন পিতা-মাতা উভয় কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তার বড় ভাই আবদুর রকীব খাঁ তাকে মাওলানা নেয়ামত উল্লাহর মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। আকরম খাঁ মরহুম মাওলানা বেলায়েত হোসেনের প্রচেষ্টায় ১৮৯৬ সালে ইংরেজি স্কুল ত্যাগ করে বিখ্যাত কোলকাতা মাদরাসায়ে আলিয়ায় ভর্তি হন। এই মাদরাসায় দীর্ঘ চার বছর অধ্যায়ন করে ১৯২০ সালে অথবা কারো কারো মতে ১৯২১ সালে এফএম পাস করেন। তাঁর জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোলকাতা আলিয়া মাদরাসাতেই থেকে সমাপ্তি ঘটে।

১৯২০ সালে আকরম খাঁ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তখন ভারতে হিন্দুদের অত্যন্ত মজবুত অবস্থান । উপমহাদেশের রাজনীতিতে তখন কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। তখন এই সংগঠনের অবস্থান খুবই দুর্বল ছিল। সরকারি চাকরি, অফিস আদালতে সর্বত্রই হিন্দুদের একচ্ছত্র আধিপত্য। আর্থিক দিক থেকে বাংলার মুসলমান সমাজ দরিদ্র চাষী শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিল। নিজেদের উন্নতির কথা চিন্তা না করে তখন মুসলমানগণ ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে সময় নষ্ট করতো। নানা কুসংস্কার ও শিরক বিদআতপূর্ণ কার্যকলাপ মুসলমানদের বিপথগামী করে তুলেছিল। জাতির এই দৈন্য অবস্থা আকরম খাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি তখন বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সর্বাগ্রে তাদের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এই চিন্তা থেকে তিনি সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন।

কুষ্টিয়ার আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামক এক প্রখ্যাত ও উদার ব্যবসায়ী খাঁ সাহেবের পিতার বন্ধু ছিলেন। তিনি একটি মাসিক পত্রিকা বের করার জন্য দীর্ঘদিন যাবত চিন্তা করেছিলেন। মওলানা আকরম খাঁকে তিনি ১৯০১ সালে ত্রৈমাসিক এবং ১৯০৩ সালে আখবারে মোহম্মদী শুধু মোহম্মদী নামে উক্ত সালের ১৮ আগস্ট আবদুল্লাহ সাহেবের প্রতিষ্ঠিত আলতাফী প্রেস থেকে পত্রিকাটি বের করেন। পনের টাকা বেতনে আকরম খাঁ উক্ত পত্রিকার সম্পাদক নিয়োগ পান। ১৯১০ সালে আকরম খাঁকে পত্রিকার স্বত্ব সহ আলতাফী প্রেস দিয়ে দেন।

আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর মাধ্যমে বহু মুসলমান তরুণকে সাংবাদিকতা পেশায় উদ্বুদ্ধ করেন। অনেক তরুণ সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এঁদের মধ্যে মোহম্মদ মোদাব্বের, আবদুল মজিদ সাহিত্যরতেœর নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯২০ সালে আকরম খাঁ ‘যামানা’ নামক একটি উর্দু পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকায় লিখতেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, আলি ভ্রাতৃদ্বয়, মাওলানা সফর আলী খাঁ, মাওলানা হাসরত মুহানী, মাওলানা আযাদ সুবহানী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী প্রমুখ। বাংলা উর্দুর পাশাপাশি মাওলানা একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা করেন। ১৯৪৩ সালে ‘কমরেড’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন।

মওলানা আকরম খাঁর রাজনৈতিক জীবন বিশাল। ১৯২৬ সালে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেসের বাংলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহেরু, সুভাষ চন্দ্র বোস, শরৎ চন্দ্র বোস, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি কংগ্রেসকে সত্যিকারের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গন্য করতেন। কিন্তু পদে পদে নানাজনের, নানা বাধায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ও মোতিলাল নেহেরুর আচরণ তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। তাই, তিনি ১৯২৭ সালে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৩৬ সালে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগ পুনর্গঠন উপলক্ষে কলিকাতায় আসেন। তখন তিনি মওলানার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেন। এদিকে মাওলানা ১৯৩৬ সালে ৩০ অক্টোবর দৈনিক আজাদ পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তাঁর মৌলিক সাংবাদিকতার কাজ চালিয়ে যান। ১৯৩৭ সালে ৩১ ডিসেম্বর মওলানা আকরম খাঁ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। ১৯৪৩, ১৯৪৪ সালে ও তিনি পুনরায় বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ১৩ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালে ২২ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড অ্যাম্বুলেন্স ব্রিগেডের কেন্দ্রীয় শিক্ষা শিবিরের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মাওলানা সভাপতিত্ব করেন।

আযাদী আন্দোলনের বীর পুরুষ মওলানা আকরম খাঁর দীর্ঘ জীবন ছিল সংগ্রামের। মুসলমানদের ইজ্জত, উন্নতি ও স্বাধীনতা কামনায় তাঁর জীবনের সকল সময় অতিক্রম করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা আকরম খাঁ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সেই সময় পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহসভাপতি এবং পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হন। এই গণপরিষদ ১৯৫৪ সালে ভেঙ্গে যায়।

১৯৬৩ সালে ৯ সেপ্টেম্বর আইয়ুব খানের প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের প্রতিবাদে মিছিলে বয়োবৃদ্ধ আকরম খাঁ নেতৃত্ব দেন। ঐতিহাসিক এই মিছিলের ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘সংবাদপত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এই বৃদ্ধ বয়সেও কারাবরণ করতে দ্বিধাবোধ করবো না।’

১৯৪৭ সালে ৫ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিশেষ বৈঠক হয়। উক্ত বৈঠক চলাকালে শত শত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ করে। ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ আন্দোলনকারীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। ঐদিন তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে ভাষার প্রশ্নে আলোচনা করেন এবং পরে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আবুল কাসেম বলেন: ‘মওলানা আকরম খাঁ আলোচনা প্রসঙ্গে তাদের আশ্বাস দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে ঘোষণা করলে তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন।’

মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন অবিরাম লেখক। সময়ের দাবিতে তিনি নানা বিষয়ে লেখেন। ত্রিশের অধিক তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সমস্যা ও সমাধান, আমপারার বাংলা অনুবাদ, মোস্তফা চরিত, বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম, মোছলেমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড), মুক্তি ও ইসলাম প্রভৃতি।

১৯৬৮ সালে ১৮ আগস্ট মওলানা আকরম খাঁ ঢাকার বংশাল আহলে হাদীস মসজিদে নামাজরত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। উক্ত মসজিদের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

লেখক: প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি., অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ
আরও পড়ুন