Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টিকা কর্মসূচির দ্বিতীয় ড্রাইভেও জটিলতা

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

যখন এই কলামটি লিখছি তখন সব কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার লকডাউন অর্থাৎ বিধি-নিষেধ বলে আর কিছু থাকবে না। অথচ, যখন এই কলামটি লিখছি তখনও দৈনিক মৃত্যু গড়ে ২৪০ এর ওপর। দৈনিক গড় সংক্রমণ ১১ হাজারেরও বেশি। অথচ, এর পাশাপাশি একটি উন্নত দেশের অবস্থা দেখুন। দেশটির নাম অস্ট্রেলিয়া। রাজধানী ক্যানবেরা। প্রধান শহর সিডনি, ব্রিসবেন, পার্থ ইত্যাদি। ক্যানবেরার জনসংখ্যা ৪ লক্ষ। সেখানে মাত্র ৪ ব্যক্তি করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। ফলে সমগ্র ক্যানবেরাকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের অধীনে আনা হয়েছে। এএফপির খবরে প্রকাশ, ইতোমধ্যেই সাড়ে তিনশত ব্যক্তি করোনা পজিটিভ এবং মেলবোর্নে শ’পাঁচেক ব্যক্তি করোনা পজিটিভ হওয়ায় ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের ১ কোটি অধিবাসীকে লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে। এসব অধিবাসী স্বেচ্ছায় লকডাউন মানছেন। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ৩ ধনীর অন্যতম বিল গেটস তার দেশে সুপারশপে সদাইপাতি কেনার জন্য ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশাপাশি বাংলাদেশের অবস্থা আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। এই অবস্থায় বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ কি সম্ভব?

টিকা নিয়ে তেলেসমতির অন্ত নাই। একটিমাত্র দেশের ওপর নির্ভর করার ফলে টিকার যে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল সেটি কারো অজানা নেই। প্রায় তিন মাস প্রতীক্ষার পর চীন থেকে কিছু টিকা আসে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ এর উদ্যোগে গঠিত কোভ্যাক্সের আওতায় কিছু টিকা পাওয়া যায়। এসব টিকা পাওয়ার পরে ঘোষণা করা হয় যে সরকার দেশব্যাপী, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও গণহারে টিকাদান অভিযান শুরু করছে। ৭ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট এই ৬ দিনে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই এই অভিযান খায় প্রচন্ড হোঁচট। হঠাৎ করে গলা নামিয়ে বলা হয় ১ কোটি নয়, ঐ ৬ দিনে ৩২ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। হঠাৎ করে টার্গেট এত কমিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। একবার বলা হয়েছে, যেহেতু দ্বিতীয় ডোজের টিকা হাতে রাখতে হবে তাই প্রথমে ১ কোটি ডোজ দেওয়ার পর পরবর্তী ১ কোটি ডোজ দেওয়ার মতো টিকা হাতে নাই। অপর এক মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনবল নাই।

এমন অস্পষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারের বহুল প্রচারিত টিকাদান অভিযান শুরু হয়। ১৩ আগস্ট একশ্রেণীর পত্রপত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হিসেবে টিকা কার্যক্রমে অরাজকতা ও জটিলতা নিয়ে রিপোর্ট করা হয়। তিনদিন আগেই মডার্নার টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার মহানগরীর অনেকগুলো কেন্দ্রে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা ছিল। ঐসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজ তো পরের কথা, ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ দেওয়ারও কোনো টিকা নাই। স্টকে কত টিকা আছে সেটি হিসাবে না নিয়েই টিকা দেওয়ার জন্য পাইকারি হারে জনগণকে আহবান জানানো হয়। শহর, উপশহর এবং ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রসমূহে হাজার হাজার মানুষ টিকা দেওয়ার জন্য জড়ো হন। বহু মানুষ টিকা পাওয়ার জন্য মধ্যরাত থেকেই লাইন দেয়। কিন্তু এদের অধিকাংশই টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। অবস্থা এখন যে, দ্বিতীয় দফায় যারা প্রথম ডোজ দিয়েছে তারা দ্বিতীয় ডোজ কবে পাবে সে ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর যারা প্রথম ডোজ না পেয়ে ফিরে গেছে তারাও জানে না, এরপর কবে তারা প্রথম ডোজ পাবে।

দুই
অথচ, গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম যখন টিকা দেওয়া শুরু হয় তখন সেটির ব্যবস্থাপনা ছিল কত চমৎকার এবং সুশৃংখল। এমন কোন কেন্দ্র নাই যেখান থেকে অব্যবস্থাপনার একটি অভিযোগও পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখা যাচ্ছে, কোভিশিল্ডের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা হয় নাই। না হলে আমেরিকা এবং কোভ্যাক্সের মডার্নার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে এমন ঘাপলা কেন হলো? লাইন ভেঙ্গে পৌর কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা আগে টিকা পান কীভাবে? কোনো কোনো কাউন্সিলরের অফিসে গিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে কেন? এভাবে ক্ষমতা এবং প্রভাব যদি টিকা দেওয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে তাহলে টিকা কর্মসূচি এবং মানবতার সেবা করার মহতি উদ্যোগই বানচাল হয়ে যাবে। সরকার বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী সেটাই করা হচ্ছে। তার মধ্যেও পত্র পত্রিকায় অভিযোগ এসেছে, কোথাও কোথাও ১ হাজার টাকা নিয়ে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলি গুরুতর অভিযোগ। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে এসব অভিযোগের তদন্ত করতে হবে এবং দোষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
সব অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। কারণ, নামোল্লেখ করে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, শ্যামলী টিবি হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতাল থেকে দ্বিতীয় ডোজ প্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই দ্বিতীয় দফা গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা। এই কর্মসূচিও প্রথমটির মতো মুখ থুবড়ে পড়বে কিনা সেটি নির্ভর করছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা প্রাপ্তির ওপর।

এ পর্যন্ত যে টিকা পাওয়া গেছে তা হলো: (১) সিনোফার্ম, কেনা টিকা ৭০ লাখ (২) সিনোফার্ম, উপহার ১১ লাখ (৩) ফাইজার, কোভ্যাক্স ১ লাখ ৬ হাজার (৪) মডার্না, কোভ্যাক্স ৫৫ লাখ (৫) অ্যাস্ট্রাজেনেকা, কেনা ৭০ লাখ (৬) অ্যাস্ট্রাজেনেকা, উপহার ৩৩ লাখ (৭) অ্যাস্ট্রাজেনেকা, কোভ্যাক্স ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৯৮০ ডোজ। মোট ২ কোটি ৯১ লাখ ১৭ হাজার ৯৮০।

টিকা দেওয়া হয়েছে (১) সিনোফার্ম ৭১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭২ (২) অ্যাস্ট্রাজেনেকা ১ কোটি ৫ লাখ ৯০ হাজার ৯১৮ (৩) ফাইজার ৮২ হাজার ৭৩৪ (৪) মডার্না ২২ লাখ ২০ হাজার ৫৮৩। যত ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে: (১) প্রথম ডোজ- ১ কোটি ৫০ লক্ষ ২৩ হাজার ১৬২ (২) দ্বিতীয় ডোজ ৫০ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪৫।

তিন
টিকা প্রাপ্তি এবং সংগ্রহের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের প্রতিটি পর্যায়েই অস্পষ্টতা। রাশিয়ার নিকট থেকে ১ কোটি টিকা কেনার কথা শোনা গিয়েছিল সেই মার্চ মাসে। এখন আগস্ট পার হচ্ছে। অর্থাৎ পাঁচ মাস পার হতে চলেছে। এখন শোনা যাচ্ছে, তাদের সাথে এখন পর্যন্ত নাকি চুক্তিই সই হয়নি। তাহলে এই পাঁচ মাস কর্তৃপক্ষ কী করলো? পত্রিকান্তরের রিপোর্ট মোতাবেক, রাশিয়ার টিকার ব্যাপারে কী হলো সেটি সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের নিকট থেকে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই মাসের মধ্যেই চুক্তি সই হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। একই নিঃশ্বাসে তিনি একথাও বলেন যে, রাশিয়ার উৎপাদন ক্ষমতা কম। এছাড়া ৬৫টি দেশে টিকা সরবরাহ করার জন্য তারা অগ্রিম চুক্তি করেছে। তিনি বলেন, ঐ ৬৫টি দেশ তো অগ্রাধিকার পাবে। তাহলে আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াচ্ছে? ঐ ৬৫টি দেশের পরের সিরিয়ালে আমরা। সেই টিকা কি ডিসেম্বরের আগে পাওয়া যাবে?

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, বাংলাদেশ রাশিয়ার নিকট প্রেরিত চাহিদাপত্রে ঠিক কী পরিমাণ টিকা রাশিয়ার নিকট থেকে চায় সেটি নাকি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি। এর ফলে রাশিয়া নাকি ‘বিরক্ত’ হয়েছে। রাশিয়া নাকি বলেছে যে, ঠিক কী পরিমাণ টিকা কত দিনের মধ্যে বাংলাদেশে চায় সেটি নাকি বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশে চীন ও রাশিয়ার টিকা উৎপাদন নিয়ে ৫/৬ মাস আগে অনেক কথা শোনা গিয়েছিল। এরমধ্যে রাশিয়া ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সেই সব দেশে টিকা উৎপাদনের চুক্তি করেছে। অথচ, বাংলাদেশ মাসের পর মাস শুধু কথাই বলে যাচ্ছে। কথা আর শেষ হয় না।
E-mail: [email protected]



 

Show all comments
  • Umme Hossain ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৬ এএম says : 0
    ২ ঘণ্টা লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষার পর শুনি টিকা শেষ, ফিরিয়ে দিয়ে বলল পরের দিন চেষ্টা করতে
    Total Reply(0) Reply
  • MD Shamim Hasan ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৬ এএম says : 0
    আগে থেকে রেজিষ্ট্রেশন করে সিডিউল অনুযায়ী টীকা প্রয়োগ করাই উত্তম ছিলো। তাতে করে টীকা গ্রহণে আগ্রহীদের ভুগান্তি কম হত.... আর সাস্থবিধি সঠিক ভাবে মানা যেত?
    Total Reply(0) Reply
  • Mainul Chapol ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৭ এএম says : 0
    কিছু অব্যবস্থাপণা থাকলেও মানুষের উৎসাহ আর আগ্রহ ছিল প্রচুর ।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Monir Hossain ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৭ এএম says : 0
    কিছুটা অব্যবস্থাপনা থাকবেই। গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। কিছুটা সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। তারপরও সরকারের এই উদ্দোগকে সাধুবাদ জানাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Akteruzzaman Mohammad Mohasin ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৭ এএম says : 0
    কিছু কিছু অব্যবস্থাপনা আমাদের ব্যক্তিগত কাজেও থাকে । এত বড় একটা কাজ, প্রতিদিন ব্যবস্থাপনা হাল নাগাদ হতেই থাকবে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Farid Hossain ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৮ এএম says : 0
    লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ২০০০ আর তারা টিকা নিয়ে আসছে ৩০০. এই হলো গনটিকার নমুনা
    Total Reply(0) Reply
  • Sumon Shikder ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৮ এএম says : 0
    এইসব নতুন কিছুনা এর মধ্যে দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে আল্লাহতালা এই মহামারী কাটিয়ে উঠার তাওফিক দান করুন
    Total Reply(0) Reply
  • Farzaina Onty ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:২৯ এএম says : 0
    এইরকম গাদাগাদি করে টিকা নিতে গেলে তো করোনা ঐখানেই আরও বেশি ছড়াবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টিকা কর্মসূচি
আরও পড়ুন