Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হিরোশিমা-নাগাসাকি এবং মার্কিনী ও জায়নবাদীদের ধারাবাহিক যুদ্ধাপরাধ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

পারমাণবিক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৫তম বার্ষিকী স্মরণ করছে বিশ্ব। বিশেষত এই আগস্ট মাসে হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরে পারমানবিক বোমা বর্ষণের দিবস পালিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষপ্রান্তে এসে জার্মানীর অগ্রযাত্রা যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, জাপানের বেসামরিক প্রশাসন যখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে সম্মত হচ্ছিল ঠিক তখনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আগস্টের ৬ তারিখ জাপানের স্থানীয় সময় হিরোশিমা শহরের প্রাণকেন্দ্র শিম হসপিটালের উপর লিটল বয় নামক ১৫ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা ফেলে শহরটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করা হয়। বিস্ফোরণের পর পুরো শহরের আকাশ বাতাস ঢেকে দেয়া মাশরুম ক্লাউড এবং বিস্ময়কর ধ্বংসক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে মার্কিন বিমান বাহিনীর সামরিক বৈমানিকরাও হতভম্ব বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর সেই ঘটনার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেলেও আগস্টের ৯ তারিখে মার্কিন বিমান বাহিনী জাপানের আরেক শহর নাগাসাকিতে ফ্যাট বয় নামের ২১ কিলোটনের ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের উচ্ছসিত মন্তব্য ছিল, ‘দ্য গ্রেটেস্ট থিং ইন হিস্টোরি’। মার্কিন ও বৃটিশ পত্রপত্রিকাগুলো এই পারমাণবিক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের উচ্ছ¡সিত প্রশংসায় উচ্চকিত হয়েছিল। রাজনৈতিক যুদ্ধ মানুষকে মানবিক দায় থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়, এসব ঘটনা থেকে তা প্রমান হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হার্বারে জাপানি বোমা হামলার পর ১৯৪৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী যুদ্ধবিমান বি-২৯ এর মাধ্যমে জাপানের ৬৫টি শহরের উপর আগুনে বোমা নিক্ষেপ করে শহরগুলোকে কার্যত পুড়িয়ে দেয়া হয়। ট্রুম্যানের যুদ্ধ পরিকল্পনায় এই ধারাবাহিকতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তত ৬৬টি শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেন্টাগনের পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বর্ষণ যুদ্ধ শেষ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল বলে মার্কিনীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে এতবড় গণহত্যার প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। তবে পারমানবিক বোমার ধ্বংসক্ষমতার কারণে এই মারনাস্ত্র প্রযুক্তি অদ্যাবধি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মূল নিয়ামক হয়ে আছে। তবে গত সত্তুর বছরে পারমানবিক প্রযুক্তি নানা দেশে ছড়িয়ে পড়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে সোভিয়েত-রাশিয়ার পারমানবিক সক্ষমতা এক ধরণের ভারসাম্য তৈরী হওয়ায় পরবর্তি কোনো যুদ্ধেই আর পারমানবিক বোমা ব্যবহৃত হয়নি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে মারমানবিক হুমকি অব্যাহত রয়েছে।

কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক-আফগানিস্তান পর্যন্ত মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হাজার হাজার পারমানবিক বোমার সক্ষমতা যুদ্ধজয়ে কোনো কাজে আসেনি। এসব প্রতিটা যুদ্ধেই পশ্চিমা বাহিনীকে অনেকটা লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে। তবে প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলোর হাতে পারমানবিক বোমা না থাকলে বিশ্বে সামরিক শক্তি ভারসাম্যহীন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফা নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াতো। যখন কোনো দেশের হাতে পারমানবিক বোমা ছিল না, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনদিনের মধ্যে দু’টি শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করতে কুণ্ঠিত হয়নি। যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি আফগানিস্তানে বৃহত্তম সমরসজ্জা নিয়ে হাজির হয়েছিল, সেখানে যদি রাশিয়ার হাতে পারমানবিক বোমা না থাকতো তাহলে সামরিক বিজয় নিশ্চিত করতে আফগানিস্তানেও হয়তো পারমানবিক বোমা ব্যবহার করত।

আমেরিকা পারমাণবিক শক্তিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিয়ামকে পরিনত না করলে হয়তো সোভিয়েত রাশিয়াকেও এমন মরিয়া হয়ে হাজার হাজার পারমানবিক বোমার মজুদ এবং আইসিবিএম ক্ষেপনাস্ত্রের প্রতিযোগিতা করতে হতো না। যুদ্ধ শুধু যুদ্ধের হুমকি ও আশঙ্কাই বাড়ায়। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ যে বিশ্ববাস্তবতার জন্ম দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার প্রভাব পড়েনি। তবে পারমানবিক প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধে সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি এবং পরবর্তি বিশ্বব্যবস্থা তথা অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে যে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের ঘোষণা দেয়া হয়, তার মূল লক্ষ্যই ছিল সমাজতন্ত্রের যে কোনো আশঙ্কাকে সমূলে উপড়ে ফেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানী ও সাম্রাজ্যবাদী জাপানের শক্তির সামনে সোভিয়েত বাহিনীর বাহিনীর চ্যালেঞ্জ ছিল অপ্রতিরোধ্য। পূর্ব ইউরোপ, জার্মানী, কোরিয়া, ভিয়েতনামে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রভাব রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশগুলোকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে দেয়। প্রায় দুই দশকব্যাপী যুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেও ভিয়েতনামে জিততে পারেনি মার্কিনীরা। তবে কোরীয় যুদ্ধে দুই কোরিয়াকে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্ত করেছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে সেই বিভক্তি এখনো টিকে আছে। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথেই বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে জার্মান জনগণ দুই জার্মানীর একত্রিকরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। কোরীয় জনগণও অভিন্ন মনোভাব পোষণ করলেও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অদৃশ্য সুতোয় ঐক্যের বদলে হুমকি ও উত্তেজনা জিইয়ে রাখা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই অনেক বেশি যুদ্ধংদেহী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিক পুঁিজবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়াকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিলেও সত্যিকারের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। আত্মরক্ষার শক্তিহীন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জনগণের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দিতে পারেনা। পেট্রোডলারে ধনী রাজতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালে এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট। ইরানের সামরিক শক্তির জুজু এবং পশ্চিমাদের ক্রীড়নক মার্সেনারি সন্ত্রাসী গ্রুপের হুমকি দেখিয়ে এসব দেশকে হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ও সামরিক চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়েছে। সউদী আরবের মত ধনী রাষ্ট্র এখন বিপুল পরিমান বাজেট ঘাটতির দেশের পরিনত হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ধার করা অস্ত্রে আর তেল বেচা অর্থে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তা বার বার প্রমানিত হয়েছে। বিশ বছরে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও বিশ্বের এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান তালেবানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করতে পারেনি। ইতিপূর্বে বৃটিশ ও সোভিয়েত বাহিনীও আফগান জাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে। ঐক্য, দেশপ্রেম ও আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করার চেতনা ফিলিস্তিন ও আফগানদের অজেয় শক্তিতে পরিনত করেছে।

মার্কিন অধ্যাপক, গবেষক জ্যাকব জি হর্নবার্গারের লেখা এক নিবন্ধের শিরোনাম, ‘ট্রুম্যান’স ওয়ারক্রাইমস অ্যাট হিরোশিমা অ্যান্ড নাগাসাকি’। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা, বঞ্চিত করেনা। বিশ্বযুদ্ধের ৭৫ বছর পেরিয়ে এসে মুক্তবুদ্ধির মার্কিন নাগরিকরাই এখন ট্রুম্যান-রুজভেল্টদের যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। চলমান ধোঁয়াশা কেটে গেলে একদিন জর্জবুশ, ক্লিন্টন, ওবামা ও ট্রাম্পদেরও মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ মানুষ হত্যার দায়ে এমন যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। জ্যাকক হর্নবাগারের মতে, পার্ল হাবার্রে বোমা হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল বা অন্য কোনো ভূ-রাজনৈতিক কারণে হয়নি। জাপানের উপর মার্কিন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রেক্ষাপটে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে তেল সম্পদের উপর জাপানিদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত রাখতেই পার্ল হারবারে বোমা হামলা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জাপানের সতর্ক বার্তা। মূলত জাপানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-খন্ডে আঘাত করতে পরোক্ষে উস্কানি দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল মধ্যপ্রাচ্যেও। ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরব্যাপী যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের প্রতি মধ্যপ্রাচ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে সর্বাত্মকভাবে পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে সহায়তা করেছিল। আত্মঘাতী যুদ্ধের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দুটি দেশই দুর্বল হয়ে পড়লে জায়নবাদি ইসরাইলের নিরাপত্তা ও দখলবাজির সহায়ক হয়। অন্যদিকে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে ইরাকের অর্থনৈতিক শক্তি নি:শেষ হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ঋণ পরিশোধ ও পুর্নগঠনের জন্য কুয়েতের উপর ইরাকের পুরনো দাবি উস্কে দিয়েছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ঋণভার পরিশোধ করতে সাদ্দাম হোসেন কুয়েতের সাথে পুরনো বিরোধ মিমাংসায় মিশরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পাশপাশি কুয়েত সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। সে সময় বাগাদের নিযুক্ত মার্কিন অ্যাম্বাসেডর এপ্রিল গøাস্পি প্রথমবারের মত সাদ্দাম হোসেনের সাথে সাক্ষাৎকারে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট জেম্স বেকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, আপনাদের আরব-আরব সীমান্ত সমস্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থান নেবে না। সাদ্দামের কুয়েত দখলের পরিকল্পনায় এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে সবুজ সংকেত। তবে সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে সেনা পাঠানোর পর, কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রস্তাব না দিয়েই ২৪ ঘন্টার সময়সীমা বেধে দিয়ে ইরাকের উপর বিশাল সামরিক অভিযান বা প্রথম গাল্ফওয়ার শুরু করে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। এরপর থেকে ইরাকের উপর একের পর এক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটিতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। দশকব্যাপী কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক যখন আবারো আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের অংশ হিসেবে ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন বা গণবিধ্বংসী সমরাস্ত্রের মজুদ থাকার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকের উপর সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয় মার্কিন বাহিনী। গোপন বাঙ্কার থেকে খুঁজে বের করে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয় মার্কিন বাহিনীর সামরিক আদালত। মধ্যপ্রাচ্যের দৃঢ়চেতা নেতাদের নিশ্চিহ্ন করার তালিকায় সাদ্দামের পরবর্তী টার্গেট ছিল লিবিয়ার আরব জাতীয়তাবাদী নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং সিরীয় নেতা বাশার আল আসাদ। ইরাকে সাদ্দামের বিচার চলাকালে লেবাননের নেতা, প্রধানমন্ত্রী রাফিক হারিরি ইসরাইলের টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হয়। পশ্চিমা বশংবদ তালিকার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের নেতৃত্ব শূন্য করার জায়নবাদি প্রয়াস কখনো থেমে থাকেনি।

মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ, টার্গেটেড কিলিং ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রজ্যবাদের অন্তহীন যুদ্ধের পেছনে কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। ইসরাইল নামক জায়নবাদী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদী অস্তিত্ব এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক ভিত্তিকে টিকিয়ে রাখতে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মুনাফা নির্ভর একটি যুদ্ধবাদী অর্থনৈতিক এজেন্ডা। মার্কিন জনগণের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও সুনামের উপর দাড়িয়ে জায়নবাদী ইসরাইলের আগ্রাসন ও যুদ্ধবাদী দর্শনকে মূল্য দিতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান নড়বড়ে করে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতি বছর ৩-৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা অস্ত্রবলে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে বছরে শত শত কোটি ডলার মার্কিন সামরিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক সহায়তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরাইল। নেগেভ মরুভূমিতে ইসরাইলের পারমানবিক প্রকল্পে শত শত পারমানবিক বোমা থাকার অভিযোগ ইসরাইল কখনো অস্বীকার করেনি। ইসরাইল এখনো এনপিটিতে সই করেনি। মার্কিন ও পশ্চিমা পক্ষপাতের কারণে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ব্যাপারে ইসরাইলের উপর কখনো কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। জেরুসালেমের উপর মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। বৃটিশ মেন্ডেটের সময়ও পূর্ব জেরুসালেমে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। আটচল্লিশ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আরব-ইসরাইল সংকটের মিমাংসায় জেরুসালেম কেন্দ্রিক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনসহ আরবরা যদি জায়নবাদি ইসরাইলের রাজনৈতিক অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় সেটাই হবে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অর্জন। ওয়াশিংটন ও লন্ডনে জায়নবাদী লবি ও থিংকট্যাঙ্কগুলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী নেতাদেরকে একদিকে হিব্রু মিথলজির প্রমিজড ল্যান্ডের ট্যাবলেট গিলাচ্ছে, অন্যদিকে জনগণের ভোগাবাদী জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক দর্শনে চীনের মত উদীয়মান অর্থনীতির সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখার জুজু হিসেবে বিশাল মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ব্যবসা ধরে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলার পর গত ৭৫ বছরে এশিয়া-ইউরোপে হাজার হাজার পারমানবিক ও হাইড্রোজেন বোমা তৈরী হয়েছে। এ কারণেই কোনো যুদ্ধেই কেউ আর এ বোমা ব্যবহারের ঝুঁকি নেয়ার সাহস করেনি। ওয়াশিংটনের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিপরীতে চীন-রাশিয়া-ইরানের এলায়েন্স অনেক বড় শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। যেখানে ইরানের প্রক্সি নিয়ে হিজবুল্লাহ-হামাসের মত মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর হাতে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা লাঠিয়াল ইসরাইলি বাহিনী বার বার মার খাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রে সজ্জিত করেও সউদী আরব ও আমিরাতের সম্মিলিত বাহিনী হুথি মিলিশিয়াদের কাছে পরাস্ত হয়। বিশ বছরে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে মার খেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তখন বোঝাই যাচ্ছে, আগামীর সম্ভাব্য চীন-মার্কিন সামরিক সংঘাতে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা ঘটতে চলেছে। সেখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, জায়নবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে চীন-রাশিয়াকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা জরুরী। একটি ক্ষুদ্র অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ ও অনৈতিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে যদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারে, সেখানে মজলুম ফিলিস্তিনী এবং শতকোটি মুসলমানের আবেগের সাথে একাত্ম হয়ে একটি নৈতিক বিজয়কে প্রতিষ্ঠিত করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। মানবাধিকার ও রক্তের মূল্যের চেয়ে যদি তেল ও বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়, তবে এই বিশ্বব্যবস্থা অচিরেই তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ অনেকটাই প্রমানিত। নেতানিয়াহুসহ শিশু হত্যাকারী আইডিএফ’র কমান্ডারদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন