Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমলাদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাড়ছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) মোতাবেক যার মালিক জনগণ। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল ধরনের শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’ সংবিধান প্রণীত হওয়ার ৫০ বছর অতিক্রম হতে চলল; কিন্তু সব ধরনের শোষণ থেকে যাদের মুক্তি প্রদানের জন্য সংবিধান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা শোষণমুক্ত হয়েছে কি? গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও নির্ভয়ে মানসম্মান ও নিজ সম্পদ রক্ষার অধিকারসহ সংবিধান প্রদত্ত যেকোনো মৌলিক অধিকার থেকে আজ বঞ্চিত নয়?

রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে কর্মের মাধ্যমে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করে প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক কর্মচারী আমলারা, যাদের বেতনভাতা গাড়ি-বাড়ির খরচ আসে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে। রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। সাংবিধানিক দিকনির্দেশনা মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার কথা থাকলেও সরকার পরিচালিত হচ্ছে কিনা সেটাই প্রশ্ন।

রাষ্ট্রীয় বেতনভুক কর্মচারী আমলাদের বেতনভাতা সরকারি দল বহন করে না। তাই কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে বারবার ক্ষমতায় আনার নৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নয়, বরং নিরপেক্ষভাবে সর্বস্তরের জনগণের ভোটাধিকারসহ তাদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, যা বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অনুপস্থিত। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এখন দলবাজিতে বেশি ব্যস্ত। হালে সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে অবসর গ্রহণ করার পর এমপি, মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ দেখা যাচ্ছে। নিজ নির্বাচনী এলাকায় দলবাজি করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করছেন তারা। এ জন্যই হয়তো রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘রাজনীতি করার জন্য যে আমার পাছায় বাড়ি মেরেছে, সে এখন আমার সাথে রাজনীতি করতে চায়।’ সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতিই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রধান ব্যক্তি এবং সংবিধানের রক্ষক। তার বক্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য ও যথার্থ। কর্মকর্তাদের আচরণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার উপলব্ধি থেকেই রাষ্ট্রপতি ওই বক্তব্য রেখেছেন তাতে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রপতি হিসেবে যদিও এখন কাগজে-কলমে তিনি একজন ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি, তথাপিও ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেয়েই তিনি পরপর দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল তার এ বক্তব্য ভালোভাবে না নেয়ারই কথা। জনগণ মনে করে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী, যাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা, তাদের দলবাজির কারণেই দলমত নির্বিশেষে মানুষ এখন সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ইতঃপূর্বে সরকারি কর্মচারীদের ছবিসংবলিত ব্যানার, পোস্টারের বিলবোর্ড এলাকায় দেখা যেত না; কিন্তু হালে যে এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা রয়েছে সে এলাকায় কোনো কোনো জায়গায় এ ধরনের ব্যানার, পোস্টার দেখা যায়। দলবাজি করে অনেক আমলা ও তাদের পরিবার আকাক্সিক্ষত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে এবং এখনো করছে। তাদের লোভনীয় পোস্টিং ও প্রমোশন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়।

আমলাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেশের জনগণকে ন্যায্য অধিকার ও পাওনা তথা রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে বঞ্চিত করেছে। রাষ্ট্রীয় সেবা পাচ্ছে একশ্রেণীর লোক, যারা ক্ষমতাসীন বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২ এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’। মাজদার হোসেন মামলায় এ মর্মে উচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অনুরূপ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হলেও এর বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। এ ছাড়াও সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলীসাপেক্ষে বিচার- কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন’। সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতা বিচার বিভাগ ভোগ করতে পারছে কি? আদালত প্রাঙ্গণসহ সর্বত্র জনশ্রুতি রয়েছে যে, সরকারের মনোরঞ্জন না করলে বদলি হতে হবে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বা দুর্গম এলাকায়। এ ছাড়াও উচ্চ আদালতে নিয়োগ বা প্রমোশন সবই নির্ভর করে সরকারের মনমানসিকতার ওপরে। ফলে বিচারিক স্বাধীনতা আজ সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার হাতে বন্দী এবং এটিই বাস্তবতা। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আমলারা কার্যকর করে তাদের মর্জিমাফিক এবং কোথাও কোথাও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আমলাদের কাছে ফাইলবন্দী হয়ে থাকে, বাস্তবায়িত বা কার্যকর হয় না। এ জন্যই প্রধান বিচারপতি আক্ষেপের সাথে বলেছেন, ‘আমরা কনটেম্পট করতে করতে হয়রান।’ বর্ণিত বক্তব্যে তার বিচারিক সিদ্ধান্ত কার্যকরকরণের ব্যর্থতার একটি সরল স্বীকারোক্তি উঠে এসেছে। আমলাদের দৌরাত্ম্য অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যাকে এখন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা বললেও অত্যুক্তি হবে না। চট্টগ্রামের লালদিয়া বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে ১১ কোটি টাকা খরচের পর প্রকল্পটি বাতিল করার জন্য মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। এতে যে আমলাদের হাতে ১১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না; পক্ষান্তরে, জনগণের টাকা গচ্ছা হয়ে গেল। অনুরূপ ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটছে; কিন্তু কোথাও কোনো আমলাকে জবাবদিহি করতে হয় না।

আমলারা জাতীয় প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হওয়ায় রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তারা অনেক ক্ষমতাধর। আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা ফিরোজ রশীদ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমলাদের উদ্ধত আচরণ সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আমলারা এখন আর সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তেমন পাত্তা দেয় না। এ অবস্থা এখন সর্বত্র। এতে পেছনের আমলাদের নৈতিকতা নয়, বরং দাম্ভিকতা কাজ করছে। রাষ্ট্রে এমনিতেই ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ চলছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকঢোল বাজিয়ে আমলাতন্ত্র আনুষ্ঠানিকতা লাভ করবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ মোতাবেক স্থানীয় শাসন ও অনুচ্ছেদ ৬৫ মোতাবেক জাতীয় সংসদ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা ও বিধিবিধান থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র হলো ভিন্ন। জেল, রিমান্ড ও লাঠিচার্জসহ মনস্তাত্তি¡ক অত্যাচারে গণমানুষ নির্যাতিত হয়েও মুখ খুলতে পারে না। কোথাও সামাজিক ন্যায়বিচার নেই, সেহেতু কেউ বিচারপ্রার্থী হতে চায় না। কিন্তু নির্যাতিত, ভুক্তভোগী জ্বলে তুষের আগুনের মতো।

পরশ্রীকাতরতা বিষণ্ণতার মতোই একটি মানসিক রোগ। যারা নিজের স্বার্থে অনায়াসে বিবেক বিক্রি করতে পারে তারাই পরশ্রীকাতর হতে অভ্যস্ত হয়। দেশে এখন চলছে বিবেক বিক্রির ব্যবসা। এ ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি লাভবান দলবাজ আমলারা; পক্ষান্তরে, নিষ্পেষিত ও অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। অধিকার আদায়ের জন্য অনেক আন্দোলন, গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান; যাতে মাথা কাটা গেছে রাজনৈতিক নেতাদের, আমলাদের নয়। পরিতাপের বিষয় এই যে, আগের চেয়ে রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আমলানির্ভরতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বটে; কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের এতে বোধোদয় হচ্ছে বলে মনে হয় না, ফলে ক্ষমতাসীনদের ভেতরেই অসন্তোষ বিরাজমান। কিছু দিন আগে ক্ষমতাসীন দলের এক এমপি বলেছেন, ‘পুলিশও এখন আওয়ামী লীগ করে।’ বাস্তবতার নিরিখে এমপির ওই বক্তব্য মোটেই অমূলক নয়; বরং জনগণ এমনটিই দেখে আসছে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • jack Ali ৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:৪১ পিএম says : 0
    ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাস অনুসারে মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। সুতরাং তার জন্য আবশ্যক হলো মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে আল্লাহর যথার্থ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যেখানে আইনদাতা হবেন মহান আল্লাহ। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তা বাস্তবায়ন করবে মাত্র। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে একজন মুমিন বিশ্বাস করে যদি মানুষ তার যাপিত জীবনে আল্লাহর আনুগত্যে সে নিষ্ঠা ও সচ্চরিত্রের অধিকারী হয় তবে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্য মানুষ সব থেকে দুর্বল প্রজাতি আর এই দুর্বল প্রজাতি আল্লাহর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজেরাই আইন প্রণয়ন করে আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ
আরও পড়ুন