পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোনো জিনিস ব্যবহার করার পর অব্যবহারযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলে আমরা তাকে আর্বজনা বা বর্জ্য পদার্থ বলি। বর্জ্য সাধারণত কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, বিষাক্ত ও বিষহীন এবং পচনশীল ও অপচনশীল হয়ে থাকে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সমস্ত জীবকূলকে রোগের হাত থেকে রক্ষা, পরিবেশ দূষণ ও অবনমন রোধের উদ্দেশ্যে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলা হয়। তবে সাধারণত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় বর্জ্যবস্তুর উৎপাদন কমানো।
বর্তমানে বর্জ্য ব্যবস্থপনায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তির রয়েছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক। বর্জ্য ব্যবস্থপনায় ত্রুটি, ভুল প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতি কারণে মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। এই পটভূমিতে পরিবেশ রক্ষার্থে গড়ে উঠেছে জৈব প্রযুক্তি। টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থপনায় জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার অতুলনীয়। কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্য, সিউয়েজ বর্জ্য, জাহাজ হতে নিঃসৃত তেল, পেট্রোল, ডিজেল, অপরিশোধিত তেল, গৃহস্থালি হতে উৎপন্ন জৈব বর্জ্য ব্যবস্থপনায় এবং যানবাহন ও কলকারখানায় উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস, দূষিত পানি ও গ্যাস পরিশোধনে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
দেশের বড় বড় শহরে যেমন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ইত্যাদিতে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে নদীর ধারে। এসব কলকারখানায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য। কলকারখানার তরল বর্জ্যে উপস্থিত থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান যেমন- ক্লোরিন, কস্টিক সোডা, সিসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম যা পানিকে দূষিত করে তুলছে। পেট্রোকেমিক্যাল, তেল শোধনগার, রাসায়নিক সার তৈরির কারখানা, রাবার ও প্লাস্টিক কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মাটি ও পানি দূষণের প্রধান উৎস। চামড়া পাকা করার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ট্যানারি থেকে প্রতিদিন উচ্চ মাত্রায় হাজার হাজার ঘন মিটার তরল বর্জ্য বের হয়ে আসছে যার মধ্যে শত শত রাসায়নিক দ্রব্য থাকে। উৎপন্ন তরল বর্জ্যের পিএইচ মান ১.৫ থেকে ১.৩ পর্যন্ত, যা পানিকে অ্যাসিটিক করে তুলে। এভাবে পানি দূষণের ফলে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকূল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পানি দূষণের ফলে জলজ জীবন সংকটাপন্ন এবং ওই পানি ব্যবহারে মানুষ বা পশুপাখিদের বিভিন্ন রোগ দেখা যায় এমনকি মৃত্যুও হতে পার। এধরনের দূষিত পানিতে ফেরিক্লক পাউডার ব্যবহার করে শোধন করা যায়। কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে বিভিন্ন প্রকার অণুজীব জন্ম নেয়, যা বর্জ্য পদার্থকে ভেঙে সরল এবং কম ক্ষতিকারক উপাদানে পরিণত করে। নির্গত বর্জ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া যেমন-Nitrobacter, Nitrosomonas, Pseudomonas, Clostridium sp. ইত্যাদি। এই সমস্ত ব্যাকটেরিয়া প্রোটিনের উৎস হিসেবে মানুষ ও পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাগজ ও কাগজের মন্ড থেকে নির্গত বর্জ্যে বিভিন্ন ইস্ট- Torula, Saccharomyces জন্মায় যা উচ্চ মাত্রাই প্রোটিন সমৃদ্ধ। এ ধরনের জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারে যেমন বর্জ্য পদার্থের দ্বারা পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে মানুষসহ অন্যান্য পশুর প্রোটিন চাহিদা পূরণ করে।
পানি দূষণের অন্যতম কারণ নৌপথপরিবহন। বাংলাদেশ প্রায় ১৬০০ থেকে ১৯০০ মাইল নৌপথে বড় জাহাজ চলাচলের উপযোগী। জাহাজ বা তেলবাহী জাহাজ হতে নিঃসৃত পেট্রোল, ডিজেল বা অপরিশোধিত তেল পানিকে দূষিত করে। অনেক সময় সমুদ্রে চালিত তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হলে জাহাজের তেল সাগরে পড়ে পুরু আস্তরণ তৈরি করে। সামুদ্রিক পাখি, মাছ, শামুক, ঝিনুক এগুলোর সংস্পর্শে আসলে মারা যায়। সমুদ্রের তেলজনিত দূষণ রোধে অণুজীবের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। কিছু অণুজীব হাইড্রোকার্বন অক্সিডাইজিং ক্ষমতা সম্পন্ন, যা তেল ভেঙে ফেলতে পারে। Pseudomonas putida নামক ব্যাকটেরিয়া অকটেন, জাইলিন, ন্যাপথালিন, কেম্পর এ চারটি প্রধান হাইড্রোকার্বনকে ভেঙে ফেলতে পারে। বর্তমানে Pseudomonas, Microbacterium, Nocardia প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়াকে সমুদ্রের তেল নিষ্কাশনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গৃহস্থল, খাদ্য তৈরির কারখানা, গবাদিপশুর খামার ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। বর্জ্যের পচনশীল দ্রব্য যেমন- তরকারি, ফলের খোসা, ঘাস, পাতা, গবাদিপশুর বিষ্ঠা (যেগুলো জৈব সার তৈরির উপযোগী) হতে জৈব সার তৈরি করা যায়। প্লান্টে মেশিনের সাহায্যে এসব বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার প্রস্তুত উপযোগী করা হয়। পরে বয়লার মেশিনে শুকিয়ে জালি বা ছাকনির মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী সার প্রস্তুত করা হয়। বাকি অংশ চলে যায় বায়োগ্যাস প্লান্টে, যা থেকে উৎপন্ন হয় বায়োগ্যাস। উৎপাদিত বায়োগ্যাস দিয়ে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। উৎপাদিত বায়োগ্যাস রান্নার কাজেও ব্যবহার করা যায়।
সিউয়েজ বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সিউয়েজ হচ্ছে জৈব ও অজৈব বর্জ্য পদার্থের তরল মিশ্রণ। বাথরুমের ব্যবহৃত সাবান পানি, রান্নাঘরের খাদ্যের অবশিষ্টাংশ, ময়লা পানি ও পয়ঃপ্রণালী হতে নির্গত মলমূত্র ইত্যাদি হচ্ছে সিউয়েজ পদার্থ। সিউয়েজ পদার্থের মধ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ক্ষতিকারক পরজীবী ও প্রোটোজোয়া ইত্যাদি ক্ষতিকর জীবাণু বাস করে। ফলে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া পরিবেশ দূষিত হয় বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠে। সিউয়েজ মধ্যে বেশি অংশ পানি থাকে এবং অবশিষ্ট অংশ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, নাইট্রেট, ফসফেট, ডিটারজেন্টে সমৃদ্ধ থাকে। জৈব প্রযুক্তি দ্বারা প্রথমে সিউয়েজ পদার্থগুলি রূপান্তর করা হয়, পরে রূপান্তরিত পদার্থগুলি প্লান্টের মাধ্যমে অত্যাধিক তাপমাত্রার জলীয় বাষ্প দ্বারা জীবাণুমুক্ত করা হয়। তারপর জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া করে মূল্যবান সার ও বিশুদ্ধ পানিতে পরিণত করা হয়। এছাড়াও জৈব প্রযুক্তি দ্বারা জৈব যৌগের পচনে জন্য Nitrosomonas, Nitrobacter, Clostridium, Protojoa প্রভৃতি অণুজীব ব্যবহার করা হয়। Bacillus denitrificans, Pseudomonas, Micrococcus সিউয়েজ পদার্থের নাইট্রেট যৌগকে ভেঙে মুক্ত বায়বীয় নাইট্রোজেনে পরিণত করে।
বর্তমানে পরিবেশ দূষণ বিশ্বের জন্য অন্যতম বড় সমস্যা। তাই টেকসই পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জৈব প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।