পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সার্বিক উন্নয়নকল্পে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। কিন্তু এত এত উন্নয়নমুখী পদক্ষেপের মাঝেও কিছু কিছু জায়গায় সুস্পষ্ট বৈষম্য রয়ে গেছে, সেখানে কর্তৃপক্ষের খানিকটা বেখেয়াল।
স্বাস্থ্যসেবা একটি ‘কমবাইন্ড টিম ওয়ার্ক’। তবে এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মূলত চিকিৎসককেন্দ্রিক। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই এ ধারণাই ধারণ করেন, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা প্রায়শই দেখি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের ১৮ কোটির বেশি মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য আরোও অনেক চিকিৎসক এবং নার্স প্রয়োজন। কিন্তু এ জায়গাটি একদম অবিহেলিত। অর্থাৎ যেভাবে ডায়াগনোসিসের মতো বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাতে ক্ষতিটা একমুখী নয়, হচ্ছে বহুমুখী।
একদিকে সাধারণ মানুষ সরকারি পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি এ খাতের জনবলকে লক্ষ লক্ষ টাকায় সরকারি খরচের মাধ্যমে তৈরি করে কেবল সনদমুখী শিক্ষার প্রসারই করা হচ্ছে। রোগ নির্ণয়সহ চিকিৎসাসেবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও রাষ্ট্রের সঠিক নজরদারির মধ্যে এখনও কেন এদের আনা হয়নি এ প্রশ্নটি কেবল উত্তরহীনই থেকে গেছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা প্রায়শই আমরা শুনতে পাই। তা কেবল চিকিৎসক ও নার্স কেন্দ্রিক। মেডিকেল টেকনোলজি পেশার বাস্তবায়নে বস্তুত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পর্দার পেছনে থেকে রোগনির্ণয়ের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও জরুরি কাজগুলো যারা করে থাকে মূলত তারাই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। রোগ নিরাময় ও সেবায় চিকিৎসকদের পাশাপাশি তাদেরও রয়েছে বিশেষ ভূমিকা, যদিও তারা সবসময়ই ফোকাস বা আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। কারণটা বহুমাত্রিক, তবে সর্বাপেক্ষা বড় কারণ হলো রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং অন্য পেশাজীবীদের দ্বারা কোণঠাসা থাকা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে এবং ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার (৪) বছর মেয়াদি ব্যাচেলর কোর্স সম্পন্ন করে, পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পরেও গ্র্যাজুয়েটদের সম্বল কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। ২০০৪-০৫ সেশন থেকে শুরু হওয়া এসব কোর্সের পাশকৃত গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি। সংখ্যা গণনায় ঠিক আরো কত হাজার সংযুক্ত হলে নীতিনির্ধারকগণ এই দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষিত, বেকার এবং অবহেলার শিকার জনবলের দিকে নজর দেবে, তা ভেবে দেখার বিষয়।
পেশাগত ডিগ্রি নিয়েও এ পেশার লোকদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বা অধিদপ্তরের কোনো স্বতন্ত্র শাখা নেই, নেই কোনো কাউন্সিলের প্রদত্ত পেশাগত সনদ। ক্যারিয়ার প্ল্যান, নিয়োগ কিংবা নিয়োগবিধি, নেই বলতে কিছুই নেই। তাহলে কী আছে! আছে সংক্ষুব্ধতা, ক্ষোভ, হতাশা বা পেশা বদলানোর হিড়িক। প্রায় ২০ বছর এতগুলো কোর্স চলমান, পাশ করে সনদ হাতে হাজার হাজার টেকনিক্যাল গ্রাজুয়েট অথচ তাদের পুনর্বাসনের জন্য বা কাজে লাগানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। তাই রাষ্ট্রের উন্নত স্বাস্থ্য সেবার যে গালগল্প তা এখানে খানিক ফিকে হয়ে আসার চিত্র পরিলক্ষিত হয়।
বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণে সারাবিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কোভিড মহামারীর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানান পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছে। মৃত্যুভয়কে পরোয়া না করে ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এ পেশার ডিপ্লোমাধারী পেশাজীবীগণ, অথচ বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে কেবল অবহেলা আর অবহেলা।
মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের গুরুত্ব, কাজ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে ভূমিকা তা বারংবার ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে উঠে এসেছে। দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্নভাবে সরকারকে এদের নিয়োগ প্রদান ও কাজে লাগানোর জন্য অনুরোধও জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসাসেবার মতো এত বড় গুরুদায়িত্ব পালন এবং করোনা মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে নমুনা সংগ্রহ, এক্সরে, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ফলাফল প্রদানসহ রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে স্ব স্ব বিভাগের লোকজন স্পর্শকাতর কাজে নিয়োজিত থাকার পরেও স্বাস্থ্য বিভাগ বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে এদের সঙ্গে।
ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ বন্ধ রাখা এবং গ্র্যাজুয়েটদের সনদ দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসিয়ে রাখা তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া কর্তৃপক্ষের নিকট জানানো হলেও এবং বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও অজানা কারণে স্বাস্থ্য বিভাগ তা শুনেও যেন না শোনার ভান করছে।
দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম তিন শিফটের মাধ্যমে দিনে ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সাত দিন চালু থাকলেও প্রয়োজনীয় জনবল অর্থাৎ মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অপর্যাপ্ততার কারণে তা দিনের নির্দিষ্ট সময় পরিচালিত হয়, যা কিনা লোকবল বাড়ানোর মাধ্যমে তিন শিফটেই চালু রাখা সম্ভব হতো। সরকারি পর্যায়ে এহেন সুবিধা না থাকায় মফস্বলের সাধারণ মানুষকে উচ্চমূল্যের বেসরকারি সেবা নিতে বাধ্য হতে হয়, যা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
অত্যন্ত দুঃখজনক, একদিকে ডিপ্লোমাধারীদের ১২ বছর ধরে নিয়োগ বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অনেকের চাকরির বয়স শেষ এবং কর্মসংস্থান না থাকায় প্রায় ত্রিশ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপরদিকে দশ সহস্রাধিক গ্র্যাজুয়েটের জন্য কোনো প্রকার পদ সৃজন কিংবা নিয়োগের চিন্তা ভাবনা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক, দেশে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা এক লক্ষ তিন হাজারের বেশি, নার্সের সংখ্যা ৭৩ হাজার এর অধিক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মোতাবেক প্রতি ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স ও ৫ জন টেকনলোজিস্ট অর্থাৎ ডাক্তার ১ : নার্স ৩ : মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৫ থাকার নির্দেশনা থাকলেও বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে ৩০ হাজার ডাক্তার এর বিপরীতে ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজার দুইশ। গ্রাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কোনো পদ এখনো সরকারি খাতে সৃষ্টি হয়নি। সরকারি পর্যায়ে আরো ২ হাজার চিকিৎসক এবং প্রায় ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং আরো ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু এতকিছুর পরও গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পেশার কোনো দ্বারই উন্মোচিত হয়নি। অথচ এ নিয়ে বর্তমানে একটি মাইলফলক সিদ্ধান্ত হতে পারতো।
স্বাস্থ্যসেবার চলমান সংকট উত্তরণ, রোগ নির্ণয় ও সেবাকে যথাযথ ও নির্ভুল এবং সাধারণ মানুষের নিকট সহজলভ্য করার লক্ষ্যে গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ পেশার মান উন্নয়ন এবং তা জনমুখীকরণের পাশাপাশি কোর্স সম্পন্নকারী গ্র্যাজুয়েটদের জন্য পদসৃষ্টি করে পদায়ন করা হলে সাধারণ মানুষের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ প্রসারিত হবে, সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত সম্প্রসারিত হবে এবং পাশাপাশি দক্ষ জনবল বহির্বিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক উন্নতির জন্য নার্সিং অধিদপ্তর এবং কাউন্সিলের মতো এ পেশার গ্র্যাজুয়েটদের এবং ডিপ্লোমাধারীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর এবং কাউন্সিল অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: মহাসচিব, বিএসসি-ডেন্টাল এসোসিয়েশন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।