পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পরিবেশ ধ্বংস ও এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বলা যেতে পারে, মানবজাতি আজ অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। একদিকে অর্থ, সম্পদ, বিলাসিতা ও ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি মানবিক প্রবৃত্তি; অন্যদিকে, নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কট। এ সঙ্কট নিরসনে মানবজাতিকে সতর্ক করতে সমগ্র বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে জনমত গঠন করা হচ্ছে। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে কমবেশি সচেতন। প্রকৃতিপ্রেমী অনেক সে^চ্ছাসেবী সংগঠনও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনে শামিল হচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নানা আইন প্রবর্তন করা হয়েছে এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। বিভিন্ন পর্যায়ে এত প্রচেষ্টা সত্তে¡ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন গণআন্দোলনের আকার নিতে পারেনি। বলা যায়, শুধু জ্ঞান বা সচেতনতা কোনও সমস্যার জন্য সমাধান হতে পারে না, যদি না তার মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়। অতএব, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের প্রভাব নিয়ে চিন্তা চর্চা করার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার দ্বারা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত, যদিও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা ভোগবাদী সমাজ কর্তৃক অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত। তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বের সকল ধর্ম শিক্ষায়ই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সতর্ক থাকতে মানবজাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এখানে এ বিষয়ে ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ও দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ইসলাম শুধু একটি আচার সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এক মহান জীবনবিধান। মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম যথোপযুক্ত দিক নির্দেশনা করেছে। আজ থেকে ১৪০০ বছরেরও অধিক কাল পূর্বে মরু আরবের মাটিতে ইসলামের শান্তি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মোহম্মদ (স.)। তখনকার দিনে হয়তো পরিবেশ সুরক্ষার চিন্তা মানুষের চেতনায় বা চিন্তনে এখনকার মতো আসেনি। তথাপি পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বাণীতে প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে মানব জাতিকে সতর্ক করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষানুযায়ী সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে প্রাণী, উদ্ভিদ, পানি, মাটি, বায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা প্রদান করেননি। শুধু মাত্র যথা প্রয়োজনে পরিমিত ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন, যাতে মানুষ পৃথিবীতে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে। আল্লাহ এ জগতকে একটি নির্দিষ্ট সিষ্টেমের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন যার পরিবর্তন, সঙ্কোচন বা পরিবর্ধন মানুষের হাতে দেওয়া হয়নি। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা, তুমি (মোহাম্মদ) একনিষ্টভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করো, আর আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল, ধর্ম (৩০:৩০)। কুরআনে আরও ঘোষণা করা হয়েছে, নিশ্চয়ই, আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক বস্তুকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছি (৫৪:৪৯)। এ সুন্দর সৃষ্টিকে মহান আল্লাহপাক খুব সুচারুভাবে গঠন করেছেন। পবিত্র কুরআন ঘোষণা করেছে, (১) পৃথিবীকে আমি (আল্লাহ) বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছি (১৫:১৯)। (২) তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা করে দিয়েছেন। তিনি আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন জোড়া জোড়া হিসেবে (২০:৫৩)। (৩) পৃথিবীতে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন পাখি উড়ে না, যারা তোমাদের মতো একটি দল নয় (৬:৩৮)।
ইসলামের মহানবী মাটি ও পানির সংরক্ষণ এবং পশু-পক্ষী, উদ্ভিদ, এমনকি কীট-পতঙ্গের প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য অতিশয় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, এ পৃথিবী আমার জন্য একটি মসজিদ রূপে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দিয়ে আমি যেন আত্মশুদ্ধি করে নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার প্রধান মাধ্যম হলো বৃক্ষরোপণ। এ প্রসঙ্গে হযরত (স.) বলেছেন, যখন কোনও বিশ্বাসী গাছের চারা রোপণ করে বা শস্য বোনে এবং এ থেকে মানুষ, পাখি বা পশু তাদের আহার্য গ্রহণ করে তখন এটা তার (রোপণকারীর) জন্য একটি সাদকা (দান) হিসেবে বিবেচিত হয় মহান আল্লাহর দরবারে। বিশ্বনবী আল্লাহর রাসুল বৃক্ষরোপণে মানবজাতিকে উৎসাহিত করে আদেশ করেছেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত সন্নিকটে এবং তোমার হাতে একটি চারা বা বীজ আছে, তথাপিও তা রোপণ কর। অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতাও ছিড়তে বারণ করেছেন আল্লাহর রসুল। তিনি ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক জীবিত পাতাই আল্লাহর গুণগান করে। যেখানে অহেতুক একটি পাতাও ছিড়তে বারণ করা হয়েছে, সেখানে নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন নিশ্চিতভাবে অপরাধ। যুদ্ধকালীন সময়েও গাছপালা তথা বনাঞ্চল ধ্বংস করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন তিনি। প্রাণী জাতের সংরক্ষণের উপর সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছে শান্তির ধর্ম ইসলাম। পবিত্র কুরআনে একজন মানুষ হত্যাকে সমগ্র মানুষ হত্যা হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে (৫:৩২)। পশুদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে এদের ক্ষুধার্ত রাখতে নিষেধ করেছেন আল্লাহর রসুল। তিনি বলেছেন, মুক প্রাণীদের বেলায় আল্লাহকে ভয় করো। পশুদের পিঠকে তোমাদের আসন বানিয়ে নিও না। পক্ষী কূলের সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে রসুল (স.) বলেছেন, যদি কেউ অন্যায়ভাবে একটি চড়–ই পাখিকে হত্যা করে তবে এর জন্য তাকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি হতে হবে। এমনকি অন্যায়ভাবে পিপীলিকা পর্যন্ত মারতে নিষেধ করেছেন আল্লাহর রাসুল (স.)।
হযরত মোহাম্মদ (স.) আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালবাসতে প্রেরণা দিয়ে ঘোষণা করেছেন, আল্লাহকে জানার পর তার সৃষ্টিকে ভালবাসাই প্রকৃত জ্ঞানের পরিচায়ক। মাটি, পানি, বন ও বণ্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য তিনি সংরক্ষিত এলাকা গঠন করার কথা ভেবেছিলেন আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে। তাঁর আদেশে পবিত্র মক্কায় গঠিত বনরাজি আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান। পরবর্তীকালে এ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ শিকার করা বন্ধ রেখেছেন। এমনকি জ্বালানি কাঠ আহরণ ও পশুচারণ পর্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
পানি সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, এ পৃথিবীর প্রাণবান সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে (২১:৩০)। বৃষ্টির পানির প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্পর্কে অনেক বেশি কথা রয়েছে পবিত্র এ গ্রন্থে। যেমন (১) তিনি আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন। এতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে তোমাদের জন্য জন্মায় উদ্ভিদ, যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাকো। তিনি এর দ্বারা শস্য জন্মান, জয়তুন, খর্জুর বৃক্ষ, দ্রাক্ষা এবং সর্বপ্রকার ফল। এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে (১৬ঃ১০-১১)। (২) আমি বৃষ্টি এবং বায়ুপ্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ হতে বারি বর্ষণ করি এবং তোমাদের তা পান করতে দেই, এর ভান্ডার তোমাদের নিকট নেই (১৫ঃ২২)। (৩) মেঘ হতে আমি প্রচুর বৃষ্টিপাত করি, তা দিয়ে উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও নথ, সন্নিবিষ্ট উদ্যান (৭৮ঃ১৪-১৬)। এভাবে পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝাতে আরও অনেক কথা রয়েছে এ ঐশীগ্রন্থে। পানি প্রদূষণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হযরত মোহাম্মদ (স.) তাঁর অনুসারীদের স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এমনকি বন্ধ পানিতে প্রস্রাব করা পাপ বলে ঘোষণা করেছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকতে বলেছেন তিনি। এজন্য ইসলামি বিধানে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, মানুষের চলাফেরার রাস্তার পাশে প্রস্রাব করা, বাহ্য ত্যাগ করা হারাম (মহাপাপ) বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানুষের জন্য মাটি কত গুরুত্বপূর্ণ তা পবিত্র কুরআনের অনেক বাণী থেকে অনুধাবন করা যায়। যেমন, (১) তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের (মানুষ) মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন (৬ঃ২)। (২) মাটি হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছি, ওতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং ঐ হতে তোমাদের পুনর্বার বের করব (২০ঃ৫৫)। (৩) তিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন এবং মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন (৩২ঃ৭)। সুতরাং মাটির গড়া মানুষকে মাটির ধরায় বাঁচতে হলে মাটির সুষ্ঠু সংরক্ষণ করতে হবে, অন্যথায় প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকা বিষময় হয়ে উঠবে।
আল্লাহর অকৃপণ দান বিশুদ্ধ বায়ু দ্বারা শ্বসনক্রিয়া চালানো প্রতিটি জীবের জন্মগত অধিকার। তাই বায়ু প্রদূষণ নিশ্চিত রূপে আল্লাহর নেয়ামত-ধ্বংস করার তুল্য অপরাধ এবং ‘হক্কুল এবাদ’ নষ্ট করার মতো পাপ কাজ বলা যায়। এমনকি শব্দদূষণও ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অনৈতিক ও কান্ডজ্ঞানহীন কাজ। শব্দদূষণের মাধ্যমে মানব সমাজে শান্তিপূর্ণ সুস্থ পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং মানব দেহের বিশেষভাবে রোগীর উপর এর কুপ্রভাব অতিশয় অনিষ্টকর।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি শুধুমাত্র মানুষকে নিয়ে নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুই তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন করতে পার না (১৭ঃ৪৪)। তাই পৃথিবীতে মানুষের উপস্থিতির জন্য সর্বপ্রকারের প্রাণী ও বৃক্ষরাজির অস্তিত্ব ও বিকাশ একান্ত প্রয়োজন। বিশেষভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষরাজির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাণী জগতের শ্বসন প্রক্রিয়ায়, ভূমিক্ষয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাসে, সুস্থ, মনোরম ও সুশীতল পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, আকাশ ও পৃথিবী এবং যা উভয়ের অন্তবর্তী, তা আমি (আল্লাহ) ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি (২১ঃ১৬)। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত মানবজাতি প্রকৃতির নিয়ম মেনে এ সৃষ্টিকে সংরক্ষিত রাখবে, পৃথিবীতে জীবন স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হতে পারে না। অতএব প্রকৃতির ধর্ম ইসলামের মূল্যবোধকে ভিত্তি করে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় সমগ্র মানবজাতির এগিয়ে আসা প্রয়োজন এবং এটাই সময়ের আহবান।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।