পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতি সপ্তাহেই মনে করি, এ সপ্তাহে আফগানিস্তানের ওপর লিখবো। এটি সোজা কথা নয় যে, বিশ্বে আমেরিকার মত একমাত্র পরাশক্তি ২০ বছর আগে পাশবিক সামরিক শক্তি দিয়ে আফগানিস্তানের মতো দরিদ্র, যার কোনো সামরিক শক্তি নাই বললেই চলে, তেমন দুর্বল এবং হীনবল একটি দেশ দখল করেছিল। সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে তারা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লক্ষ লক্ষ বীর আফগানকে হত্যা করেছে। সেখানে কোনো যুদ্ধ হয়েছে, সে কথা আমি স্বীকার করবো না। কারণ যুদ্ধ হয় দুই পক্ষে। আফগানিস্তানে আমেরিকা একা সামরিক অভিযান চালায়নি। সাথে নিয়ে এসেছিল তাদের তাবেদার সামরিক জোট ন্যাটোকে। তারপরেও জয়ের ব্যাপারে মার্কিনীরা পূর্ণ আস্থাবান হতে পারেনি। আফগানিস্তানের সমগ্র উত্তর ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে রয়েছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনে জড়িত হতে চায়নি পাকিস্তান। তখন জর্জ বুশের জামানা। উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন রিচার্ড আর্মিটেজ। আমি তখন নিয়ে নিউইয়র্ক অবস্থান করছি।
একদিন সকালে উঠে ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’ দেখলাম, ব্যানার হেডলাইন দিয়ে শিরোনাম। রিচার্ড আর্মিটেজ পাকিস্তান এসেছেন। বৈঠকে বসেছেন পাকিস্তানের মিলিটারী প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সাথে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে তিনি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় বলেছেন, ‘আপনাদের (পাকিস্তানের) সামনে কোনো অপশন নাই। এই যুদ্ধে হয় আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। নাহয় আফগানদের সাথে থাকবেন। নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ আপনাদের নাই। যদি আপনারা আফগানদের সাথে থাকেন তাহলে আমরা পাকিস্তানের ওপর এত বোমা মারবো যে আপনারা প্রস্তর যুগে ফিরে যাবেন।’ এরপর পাকিস্তানের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
আফগানিস্তান মার্কিন পদানত হলো। ২০ বছর ধরে তারা মার্কিন পদতলে পিষ্ট হয়েছে। তাদের মেরুদন্ড মচ্কে গেছে। কিন্তু তারা ভাঙ্গেনি। তারা মার খেয়েছে, লক্ষ লক্ষ বীর আফগান বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেনি। পরাজয় বা গোলামী আফগানদের ধাতে নাই।
সূদূর অতীতের কথা না হয় নাই তুললাম, ১০০ বছর পেছনে যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখবো, সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়ারা তিনবার আফগানিস্তান আক্রমণ করেছে। তারা হয়তো অত্যন্ত সুপিরিয়র অস্ত্র শস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের কারণে সাময়িকভাবে দেশটি দখল করতে পেরেছিল। কিন্তু ইংরেজদের চুড়ান্ত পরাজয় ঘটে ১৯৩৯ সালে এবং বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্র নেতৃত্বে দেশটি গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করে গর্বোন্নত শিরে আজাদীর নিশান উড্ডীন করে। কিন্তু খুব বেশি দিন আফগানরা স্বাধীন থাকতে পারেনি। ১৯৭৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সোভিয়েট নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এক লাখের বেশি সৈন্য এবং সেই সময়কার সর্বাধুনিক রুশ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে হামলা করেন এবং আফগানিস্তান দখল করেন। তখন তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান সোভিয়েট ইউনিয়নের অধীনে ছিল। আর এই তিনটি দেশের সাথে আফগানদের রয়েছে অভিন্ন সীমান্ত। তারপরেও সোভিয়েট দখলদারিত্ব স্থায়ী হয় নাই। আফগানিস্তান জুড়ে ইসলামী বাহিনী তালেবান- কোথাও গেরিলা যুদ্ধ এবং কোথাও সম্মুখ যুদ্ধে সোভিয়েট ইউনিয়নকে পরাজিত করে। ১০ বছর পর সোভিয়েট বাহিনী পিছু হটে এবং ইসলামী তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
দুই
সেই সরকারকেও টিকতে দেয়নি আমেরিকা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য আমেরিকা আল-কায়েদা এবং তার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে। ওসামা এবং আল-কায়েদার নেতারা আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন, এই অভিযোগ করে আমেরিকা ওসামা এবং আল-কায়েদা নেতাদেরকে আমেরিকার হাতে তুলে তুলে দেওয়ার দাবী জানায়। আফগান সরকার, অর্থাৎ মোল্লা ওমরের তালেবান সরকার দাবি করে যে, মার্কিন সরকার অকাট্য প্রমাণ দিক যে, ওসামা এবং আল-কায়েদা ৯/১১ তথা টুইন টাওয়ার হামলা করেছে। শুধু তখন কেন, আজ ২০ বছর হলো, টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার জন্য ওসামা এবং আল-কায়েদাই যে দায়ী, সেই প্রমাণ দিতে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষুব্ধ মার্কিনীরা ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাটো সহ আফগানিস্তানে সর্বাত্মক হামলা চালায় এবং ঐ বছরের ১৭ ডিসেম্বর তালেবান সরকারকে উৎখাত করে দেশটি দখল করে।
পরবর্তী ২০ বছর। সারা আফগানিস্তানে ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েছে মার্কিন ও মিত্র বাহিনী। বীরের জাত আফগানরা। মার খেয়েছে, রক্ত দিয়েছে, কিন্তু মার্কিনীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি। ২০১১ সালের ১ মে আমেরিকা আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ভঙ্গ করে পাকিস্তানের বিনা অনুমতিতে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে এবোটাবাদে বসবাসরত ওসামার বাসভবনে হেলিকপ্টার থেকে কমান্ডোরা অবতরণ করে। তারা প্রথমে ওসামার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ থেকে গুলি করে ওসামাকে হত্যা করে। অত:পর তার লাশ হেলিকপ্টারে তুলে বঙ্গোপসাগরের অথৈ নীল জলরাশিতে নিক্ষেপ করে। সাগরের নীল জলরাশিতে তার সলিল সমাধি হয়। একজন মুসলমানের প্রাপ্য দাফন কাফন থেকেও মার্কিনীরা তাকে বঞ্চিত করে।
মার্কিনীদের ভয় ছিল, ওসামাকে যদি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের কোথাও দাফন করা হয় তাহলে তার কবর হয়ে উঠবে ইসলামী বিপ্লবীদের মাজার। লক্ষ লক্ষ মুসলমান বিপ্লবীরা সেই মাজার জিয়ারত করবে এবং মার্কিন বিরোধী লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা পাবে। সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন অনেক ভেবে চিন্তে তাকে সমাধিস্থ না করে আরব সাগরে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন।
তিন
এত কিছু করেও আমেরিকার শেষ রক্ষা হলো না। ২০ বছর ধরে হাজার হাজার সৈন্য নামিয়ে, তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ তিন লক্ষ কোটি টাকা (বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেক) গচ্চা দিয়েও জয়ের মুখ দেখতে পারেনি আমেরিকা। আফগানিস্তানের পৌনে চার কোটি মানুষের একজনও মার্কিন অভিযানের সমর্থন নয়। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিকে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। তারই মহড়া হিসাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক ঘাটি বাগরাম থেকে রাতের আঁধারে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে সরে এসেছে তারা। আর ঐ দিকে বীর বিক্রমে তালেবান বাহিনী একের পর এক আফগান শহর ও জেলা দখল করছে। সমগ্র দেশটির দখল এবং সরকার প্রতিষ্ঠা এখন তালেবানদের কাছে শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিগত ১০০ বছরে এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে আফগানরা বীরের জাতি। তারা অজেয়। তারা অদম্য। তাদের কাছে তিন বার পরাজিত হয়েছে ইংরেজরা। একবার রুশরা। আর সব শেষে মার্কিনীরা।
চার
আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারপর? তারপর কি হবে? এটিই এখন সচেতন বিশ্বসাবীর কাছে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ আফগানিস্তানের সাথে জড়িয়েছিল ইংরেজ, রুশ এবং মার্কিনীরা। ২০ বছর আগে চীন বিশ্ব রাজনীতিতে তেমন কোনো ফ্যাক্টর ছিল না। কিন্তু এখন তারা বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি। শুধুমাত্র অর্থনীতির ক্ষেত্রেই কেনো, সব ক্ষেত্রেই চীন বিশ্বের অপর একটি পরাশক্তি হবে এবং আমেরিকার প্রতিদ্ব›দ্বী হবে, তেমনই ভাবছে আমেরিকা। ভারতের সাথে আফগানিস্তানের কোনো সীমান্ত নাই। তবুও আমেরিকা চলে গেলে আফগানিস্তানে কাদের প্রভাব বাড়বে, সেটি নিয়ে ভারত খুব চিন্তিত। কিন্তু চীনের সাথে ছোট হলেও আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। আমেরিকা চায়, তারা চলে গেলে দেশটি ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকুক। কিন্তু সেটি হবার নয়। আফগানিস্তানের সাথে সবচেয়ে বড় এবং বিস্তীর্ণ সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। তারপরেই দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ইরানের। সুতরাং ভূগোলের স্বাভাবিক নিয়মে আফগানিস্তানের সাথে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ থাকবে পাকিস্তানের। তারপর দেশটি নিয়ে ভাবনা থাকবে ইরানের। আফগানিস্তানের উত্তর, উত্তর পশ্চিম এবং উত্তর পূর্বে রয়েছে তিনটি দেশ। এই তিনটি দেশ হলো উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং তাজিকিস্তান। অতীতে এই তিনটি দেশ ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের অধীনে। তাই ১৯৭৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন সামরিক অভিযান করে আফগানিস্তান পদানত করে। কিন্তু ঐ তিনটি দেশ এখন স্বাধীন। তাই আফগানিস্তানে রুশ আগ্রহ কমে গেছে।
আফগানিস্তানের সকলেই আফগান। কিন্তু তারপরেও তাদের রায়েছে নৃতাত্বিক পরিচয়। দেশটির আয়তন ২ লক্ষ ৫১ হাজার ৮৩০ বর্গমাইল। অর্থাৎ বাংলাদেশের ৫ গুনেরও একটু বড়। জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ পশতুন, অর্থাৎ পাঠান। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খোয়ার (সাবেক নাম উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) সাড়ে ৩ কোটি অধিবাসীও পশতুন, অর্থাৎ পাঠান। পাক আফগান সীমান্তের উত্তরে ১ কোটি ৫৭ লক্ষ পাঠান, দক্ষিণে সাড়ে ৩ কোটি পাঠান। অর্থাৎ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে রয়েছে ৫ কোটি পাঠান। তালেবানদের অধিকাংশ নেতা ও কর্মী পাঠান। আফগান জনগোষ্ঠির ২৭ শতাংশ তাজিক, আর ৯ শতাংশ উজবেক এবং ৯ শতাংশ হাজারা। ১১ সেপ্টেম্বরের পর আফগানিস্তানে সরকার বদল হবে। সৃষ্টি হবে নতুন পরিস্থিতি। কী হবে সেই পরিস্থিতি সে সম্পর্কে পরবর্তী কোনো এক সময়ে আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।
E-mail: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।