পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যা আশঙ্কা করা গিয়েছিলো অবশেষে তাই ঘটেছে। আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর পাকিস্তানে সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। গত মঙ্গলবার ভারত সার্কের বর্তমান চেয়ারম্যান নেপালকে জানিয়ে দেয় যে, উপমহাদেশে বর্তমানে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং যে ভাবে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়ে গেছে, তার ফলে সার্কের মতো একটি বহুজাতিক আঞ্চলিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠান করার মতো পরিবেশ নেই। তাই ভারত এই আসন্ন সম্মেলনে যোগদানে অসমর্থ। ভারতের অপারগতা জ্ঞাপনের পর ভুটান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশও সম্মেলনে যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে গত বুধবার সার্কের বর্তমান চেয়ারম্যান নেপালের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, এই সব দেশ সম্মেলনে যোগদানে অসমর্থ হওয়ায় ৯ ও ১০ই নভেম্বর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে। কারণ যাই হোক না কেন, দক্ষিণ এশিয়ার ৮ জাতি সমবায়ে গঠিত এই আঞ্চলিক সম্মেলনটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত বুধবার তার অফিসে সাংবাদিকদের জানান যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করায় বাংলাদেশ এই সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকছে। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, ভারত এই সম্মেলন বর্জন করেছে বলে বাংলাদেশও কী বর্জন করলো? জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এই ব্যাপারে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা চলছে এবং দুই দেশের য্দ্ধুংদেহী মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার ফলে সার্কের নভেম্বরের সম্মেলনই শুধু নয়, সার্কের ভবিষ্যতও বিপন্ন হয়েছে। সম্মেলনে যোগদান না করার ব্যাপারে বাংলাদেশ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে বাংলাদেশের সেই বক্তব্যে অনেকের কাছেই কনভিনসিন্ড হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ বলেছে যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দ- প্রদানের ক্ষেত্রে পাকিস্তান বার বার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এ কারণে বাংলাদেশের পক্ষে আসন্ন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করা সম্ভব নয়। এই যুক্তিটি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন বর্জনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করছেন। তারা বলেন, দু’টি দেশ যখন যুুুুদ্ধে লিপ্ত থাকে তখন সেই যুদ্ধ চলাকালেও তারা গোপনে বৈঠক করে, এমন নজির বিশ্বে বিরল নয়। ভিয়েতনামে বছরের পর বছর যুদ্ধ চলেছে। সেই যুদ্ধের মধ্যে এক পক্ষ আমেরিকা এবং অপর পক্ষ ভিয়েতনাম ও তার মিত্র চীন আমেরিকার সাথে বৈঠক করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সাথে আরব জাহানের যখন যুদ্ধ চলে তখনও ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা ও ইসরাইলের প্রতিনিধির সাথে আরব প্রতিনিধিদের নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অনেক বৈঠক হয়েছে। এবারেও যখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়েছিলো তখনও পাকিস্তান আলোচনায় বসার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের যা ঘটেছে সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ তো দূরের কথা, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব খারাপ ছিলো। যুদ্ধোত্তর বিতর্ক এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় অব্যাহত ছিলো। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া, ৫ লক্ষ বিহারীকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানের নিকট থেকে বাংলাদেশের পাওনা আদায়, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যের বিচার প্রভৃতি ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনার সম্পর্ক বিরাজ করছিলো। এমন খারাপ সম্পর্কের মাঝেও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, যে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর গণহত্যা ও অন্যান্য অত্যাচারের নেপথ্য নায়ক বলে বর্ণনা করা হয়, সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো ঐ বছরের জুন মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশের জনগণ এবং শেখ মুজিবের সরকার বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করে। এই পটভূমিতে যে যুক্তিতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সার্ক সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকছে সেটি জনগণের কাছে কতদূর গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা গত বুধবার প্রশ্ন করেছিলেন যে, ভারত এই সম্মেলন বর্জন করছে বলেই বাংলাদেশও কি সেটি বর্জন করছে?
ভুটান এবং আফগানিস্তান এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে না। তাদের সাথে সাথে বাংলাদেশও যোগদান করছে না। ভুটান ও আফগানিস্তানের সাথে কী বাংলাদেশকে এক ব্রাকেটে বা এক সমীকরণে ফেলা যায়? অবশ্যই যায় না। কারণ, এই উপমহাদেশের তিন শক্তিধর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। তাই বাংলাদেশ যা করে বা বলে উপমহাদেশে অবশ্যই তার ছায়াপাত ঘটে। সার্কের ব্যাপারে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা তুলনামূলকভাবে বেশী। কারণ, সার্ক বাংলাদেশেরই ব্রেইন চাইল্ড, অর্থাৎ সার্ক বাংলাদেশের চিন্তার ফসল। ভারত এই সম্মেলন বর্জন করবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আসলে শুরু থেকেই ভারত একটি শক্তিশালী সার্ক চায়নি। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার যখন সার্ক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখনই ভারত এ ধরনের আঞ্চলিক জোট গঠনের কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু অন্যান্য ছোট রাষ্ট্র আগ্রহী এবং উদ্যোগী হওয়ায় ভারতের অনাগ্রহ সত্ত্বেও সার্ক গঠিত হয়েছে। তারপর ৩০ বছর পার হয়ে গেল। এই ৩০ বছরে সার্কের ৩০টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো না কোনো বাহানাতে ভারত যোগদান না করায় সার্কের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সে কারণেই আগামী নভেম্বরে সার্কের ১৯তম সম্মেলন হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু প্রধানত ভারতীয় অনীহার ফলে সেই সম্মেলনটিও ভ-ুল হয়ে গেল। সার্ককে অথর্ব এবং অকার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ-নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে ভারত বিমস্টেকসহ একাধিক উপ-আঞ্চলিক জোট গঠন করেছে। সার্ক সনদে এক অনুচ্ছেদ রয়েছে যে, সার্ক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিতর্কিত দ্বিপাক্ষিক বিষয় সার্কের বৈঠকে উত্থাপন করা যাবে না। এই অনুচ্ছেদটি সনদে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোক্তা ছিলো ভারত। যদি সার্কের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বিষয় উত্থাপন করা যেতো তাহলে আঞ্চলিক ভিত্তিতেই অনেক দ্বিপাক্ষিক বিরোধের সমাধান করা যেত। তাহলে সার্ক আরো শক্তিশালী হতো। ভারতের অনাগ্রহ এবং বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে ভারত যেভাবে জোটের মধ্যে জোট গঠন করার কাজ করে যাচ্ছে তার ফলে শুধু আগামী শীর্ষ সম্মেলনই নয়, সার্কের ভবিষ্যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সার্ক যদি বিপন্ন হয় তাহলে ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া অপর ৬টি রাষ্ট্রের সামষ্টিক স্বার্থও বিপন্ন হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।