পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রবল বর্ষণে সিলেট মহানগরীতে যে দৃশ্যের অবতারণা হয় তা শুধু নজিরবিহীন নয়, আশঙ্কাজনকও বটে। স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি ক’দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে সিলেট শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে, রাস্তাঘাটে, দোকানপাট ও বসতবাড়িতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মাত্র ক’ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টিপাত হলেই নগরীর কোন কোন স্থানে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং এমনকি কোন কোন ভবনের নিচতলা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। দরজা-জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর পানি ঢুকতে দেখা যায়, যা নজিরবিহীন। নিকট অতীতেও এর চেয়ে ভারী বর্ষণ নগরবাসী দেখেছে কিন্তু এমন পানিবদ্ধতা শত বছরেও সিলেট শহরে দেখা যায়নি বলে নবতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অভিমত। মাত্র কয়েক দিনের বর্ষণে মহানগরীর ১৫ ভাগেই পানি জমে যায় এবং মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ মৌসুমী বায়ুর দেশ। এই বায়ুর প্রভাবে এ দেশে শত শত বছর ধরে বছরের একটি সময়ে দু’তিন মাস ধরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হয়ে আসছে যে জন্য বাংলার ঋতুচক্রে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল বলে চিহ্নিত হয়েছে। ১০/১৫ বছর আগেও বর্ষাকালে ৮/১০ দিন পর্যন্ত একটানা বর্ষণ হতো এবং কখনও ভারী বর্ষণও হতো। কিন্তু তখনও সিলেট মহানগরীতে এমন পানি জমে যাওয়ার দৃশ্য কাউকে দেখতে হয়নি। এখন সিলেট শহর মহানগরীতে পরিণত হয়েছে, সিলেট মিউনিসিপ্যালিটি সিটি কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে, নগরীতে শত শত বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে অথচ এখনই মাত্র কয়েক দিনের বৃষ্টিতে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ডুবে যাচ্ছে। এ অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে হয়ত আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মহানগরীর অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় মানুষ বসবাসই করতে পারবে না।
যে কোন স্থানেই পানি জমে যাওয়ার মূলে রয়েছে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থার অভাব। এক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ত্রুটি অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমানে মাঝারি বর্ষণেও নগরীর নিম্নাঞ্চল যেভাবে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তাতে নগরীতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে সিলেট মহানগরীর এমন বেহাল অবস্থার সৃষ্টি একদিনে বা এক বছরে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে প্রাসাদ-সৌধ-বহুতল ভবন গড়ে তোলা, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ত্রুটি, পাহাড় নিধন ইত্যাদি চলতে দেওয়ার ফলে আজ নগরবাসীকে পানিবদ্ধতার হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মহানগরীর বিরাট এলাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খাল ও ছড়া। এসব খাল ও ছড়াগুলো পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনে অক্ষম। খালগুলো সংস্কারের জন্য গত ২০ বছর ধরে নানা কাজ, কোটি কোটি ব্যয় করেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। অভিজ্ঞমহলের অভিযোগ হলো, এসব খাল সংস্কারের নামে কেবল রাজনীতি ও লুটপাটই চলেছে। দেখা যায়, বিভিন্ন খালের মাটি কেটে খালের পাড়েই রাখা হয়, বৃষ্টিতে সে মাটি আবার খালে পড়ে গিয়ে খালের বুক ভরিয়ে তোলে। তাছাড়া খালের উপর অবৈধভাবে বাড়িঘর, দোকানপাট গড়ে তোলা হলে, নির্বিচারে পলিথিনসহ খালে বর্জ্য ফেলা হলে, নিয়মিত পানি অপসারণ কাজ না চললে খাল ভরে যেতেই পারে। বলতে গেলে সিলেট নগরীর খাল কোনদিনই সুপরিকল্পিতভাবে খনন করা হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান অবলম্বনটি নিয়েই যদি এমন অবাঞ্ছিত কাজকর্ম চলে তা হলে নগরীতে পানিজট তো হতেই পারে। তাছাড়া মহানগরীর বিভিন্ন নালানর্দমার অধিকাংশই অবৈধ দখলদারদের নির্মিত ভবন, দেয়াল, দোকানপাটের অংশ হয়ে গেছে। নতুন গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় পানি নিষ্কাশনের পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নগরীর বিভিন্ন স্থানে পানি নিষ্কাশনের নালার ওপর কালভার্ট রয়েছে। এসব কালভার্টের সংস্কার তো হয়ই না বরং বর্জ্যে ভরে যায়। নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড়ী ঢল ও মাটি নেমে এসে এলাকাতো প্লাবিত করেই, উপরন্তু পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথগুলোও রুদ্ধ করে দেয়। এতসব অনিয়ম, ত্রুটি ও অব্যবস্থা বছরের পর বছর চলতে থাকলে নগরবাসীর পানিবন্দী না হয়ে উপায় কী!
বস্তুত সিলেট মহানগরীকে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে হলে সুষ্ঠুপরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব হলেও প্রশাসনেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। নগরে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠবেই। কিন্তু যেনতেন প্রকারে, নির্বিচারে পাহাড় বা তার পাদদেশ কেটে বস্তি গড়ে উঠলে পানিবদ্ধতা বন্ধ করা যাবে না। বাড়ি-ঘর, বসত তৈরির ক্ষেত্রটি বা উন্নয়ন সিটি কর্তৃপক্ষেরই এখতিয়ার। বিভিন্ন খালসহ মহানগরীকে ঘিরে যে সব ছোট ছোট খাল রয়েছে সেগুলো পরিকল্পিতভাবে সংস্কার যেমন পানিজট দূর করার জন্য অপরিহার্য তেমনি খনন কাজে রাজনীতি ও লুটপাটের মনোবৃত্তি না থাকাটাও একান্ত প্রয়োজনীয়। পানি নিষ্কাশনের জন্য বছর কয়েক আগে প্রণীত মহাপরিকল্পনাটিও সরকারের বিবেচনায় আনা দরকার। মোট কথা, সরকার, স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাগুলোসহ সকলেই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না এলে চলবে না।
সিলেটে তিন জন মন্ত্রী রয়েছেন, তারা এবং সংসদ সদস্যরা সিলেটের স্বার্থে একযোগে এ ব্যাপারে সরকারের কাছে দেন দরবার করতে পারেন। সকলের আন্তরিক সম্মিলিত প্রয়াসে শুধু পানিজট নয়, অনেক জটেরই নিরসন সম্ভব। সিলেটের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এই সম্মিলিত প্রয়াসই নাগরিকদের কাম্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।