পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান, যা সহজতর করছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে। এর সঙ্গে সঙ্গে সমহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদির পরিমাণ। দিন শেষে দেখা যায়, ব্যবহার্য অনেক জিনিস আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। সেগুলো আমরা অব্যবহারযোগ্য বা অপ্রয়োজনীয় বলে ফেলে দেই। আমরা যে জিনিসপত্রগুলো বর্জন করি বা ফেলে দেই তাই হচ্ছে বর্জ্য। এই ফেলে দেওয়া বর্জ্যের মাঝে যে সকল বর্জ্য কঠিন প্রকৃতির বা বহমান প্রকৃতির নয় সেগুলোকে বলা হয় কঠিন বর্জ্য। কঠিন বর্জ্যকে ময়লা, আবর্জনা, জঞ্জাল এবং আরো নানাভাবে আখ্যায়িত করা হয়, যা আমাদের পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টিসহ নানা প্রকার সমস্যার সম্মুখীন করে। কিন্তু এর উৎপাদন সম্পর্কিত সঠিক ধারণা থাকলে এই সমস্যার উত্তম সমাধানের পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য থেকে আসতে পারে সম্ভাবনার পথ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীতে প্রতিবছর ২.০১ বিলিয়ন টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। ২০৫০ সালে এর পরিমাণ ৩.৪০ বিলিয়ন টনে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই পরিবেশবান্ধবভাবে ব্যবস্থা করা হয় না। বিশ্বব্যাপী একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ০.৭৪ কিলোগ্রাম কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন করে। যেখানে উৎপাদিত বর্জ্যরে প্রায় ৩৫ শতাংশই আসে উন্নত দেশসমূহ থেকে, যা ২০৫০ সাল পর্যন্ত আরো ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মধ্যম আয়ের এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে যা ৪০ শতাংশ হতে পারে। পৃথিবীর উৎপাদিত মোট কঠিন বর্জ্যরে মাঝে পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সর্বাধিক ২৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকার দেশসমূহ সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ উৎপাদন করে। বাংলাদেশ দৈনিক প্রায় ৩৭০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন করে, যা ২০২৫ সালে ৪৭,০৬৪ টন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১২ সালে দেশে মোট উৎপাদিত বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ২২.৪ মিলিয়ন টন। প্রতিদিন শুধু পৌর এলাকায় ২৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যা মাথাপিছু ১৭০ কেজি।
প্রতিদিনই পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ফলে এর প্রকৃতি এবং রাসায়নিক গঠন সবই ভিন্ন হয়ে থাকে। গঠন অনুসারে এই সকল বর্জ্যরে আবার প্রভাবও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই বর্জ্যসমূহের উৎপাদন উৎস সম্পর্কিত আলাদাভাবে বিন্যস্ত করা হয়। কঠিন বর্জ্যের উৎপাদন উৎস, এর গঠন অনুসারে এগুলো বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। এই প্রকারগুলোর মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে পৌর বর্জ্য গৃহস্থালী কঠিন বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য, কৃষিজ কঠিন বর্র্জ্য, চিকিৎসা ক্ষেত্রের কঠিন বর্জ্য, তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য এবং অন্যান্য। পৌর এলাকায় উৎপাদিত সকল প্রকার কঠিন বর্জ্যই পৌর বা মিউনিসিপল কঠিন বর্জ্যের অন্তভুর্ক্ত। গৃহস্থালী কঠিন বর্জ্যের মাঝে রয়েছে খাদ্য বর্জ্য, গৃহস্থালী ব্যবহার্য জিনিসপত্র হতে উৎপন্ন কঠিন বর্জ্যসমূহ। আরো রয়েছে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স পণ্য হতে আগত কঠিন বর্জ্য, যাকে ই-বর্জ্যও বলা হয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার শিল্প কারখানা রয়েছে যেমন, পোশাক শিল্প, ধাতব শিল্প, ট্যানারি শিল্প, নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি সকল শিল্পে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যই শিল্প বর্জ্যের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কঠিন বর্জ্য, যেগুলো মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারাগার, বিভিন্ন অফিস, আদালত হতে আগত। হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সামগ্রী হতে উৎপন্ন সকল কঠিন বর্জ্যই হচ্ছে চিকিৎসা খাতের কঠিন বর্জ্য। উল্লেখিত কঠিন বর্জ্যসমূহের উৎস যেমন ভিন্ন ভিন্ন তেমনি উৎস অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থাপনাগুলো হয় উৎপাদিত বর্জ্যরে প্রকৃতি অনুযায়ী।
এখন দেখি উৎস অনুযায়ী কঠিন বর্জ্যগুলো কী কী হয়ে থাকে। শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকেই শিল্প হতে আগত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মাঝে ধাতব পদার্থ, গ্লোকজ, ছাই, পেপার ও পেপারজাত পণ্য, কাপড় বা ন্যাকড়া, টায়ার, টিউব, পাইপ ইত্যাদি। উন্নত দেশসমূহে সর্বাধিক পেপার এবং পেপার জাতীয় কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। খাদ্য দ্রব্য থেকে উৎপন্ন কঠিন বর্জ্যই হলো বিশ্বব্যাপী উৎপন্ন কঠিন বর্জ্যরে সবচেয়ে বৃহৎ উৎস। খাদ্য থেকে আসা কঠিন বজ্যগুলো হলো উচ্ছিষ্ট খাদ্য, খাবার প্যাকেজিং, ম্যাটারিয়ালস্, সবজির খোসা, প্লাস্টিক বোতল, বোতলের কর্ক, এবং অন্যান্য। গৃহস্থালীর নানা অব্যবহৃত কঠিন জিনিসপত্র থেকে কঠিন বর্জ্যের আরেকটি বড় অংশ আসে বা উৎপন্ন হয়। এই সকল বর্জ্যরে মাঝে রয়েছে ব্রাশ, বলপেন, পেপার, আইসক্রিমের পট, প্লাস্টিকজাত পণ্য, ভাঙ্গা কাচ, টিন ও টিনজাত দ্রব্য, লোহার টুকরা, কাঠ, জুতা ইত্যাদি। চিকিৎসা খাত হতে আগত কঠিন বর্জ্যসমূহ হলো, ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া সিরিঞ্জ, ঔষধের খোসা, রক্ত ও স্যালাইনের ব্যাগ, চুল, হাড়, এক্স-রে পেপার, ও অন্যান্য ব্যবহার্য্য সামগ্রী। কৃষিজ কঠিন বর্জ্যরে মাঝে রয়েছে শস্যের খোসা, অব্যহৃত খড়, পশুপাখির বর্জ্য। ইলেক্ট্রনিক্স কঠিন বর্জ্যের অন্তর্ভুক্ত বর্জ্যগুলো হলো ব্যবহার অনুপযোগী কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশ,টিভি, ফ্রিজ, ফ্যান, এসি, বৈদ্যুতিক তার, মোবাইল ও অন্যান্য সামগ্রী। প্রাতিষ্ঠানিক কঠিন বর্জ্যরে মাঝে কাঠ ও কাঠজাত পণ্যই সর্বাধিক। তেজষ্ক্রিয় কঠিন বর্জ্যরে মাঝে নিউক্লিয়ার পাওয়া থেকে উৎপন্ন বর্জ্য যেমন ইউরিনিয়াম জাঞ্জল অন্যতম।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, পৃথিবীব্যাপী উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যরে ৪৪ শতাংশ হচ্ছে খাদ্য এবং খাদ্য সম্পর্কিত কঠিন বর্জ্য, ৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য হচ্ছে কাচ ও কাচজাতীয় পণ্য। ধাতব বর্জ্যরে পরিমাণ ৪ শতাংশ। কাঠ, লেদার এবং রাবার জাতীয় পণ্য হতে মোট ৪ শতাংশ কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কঠিন বর্জ্যরে মাঝে সমসাময়িক সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত কঠিন বর্জ্য, যা প্রায় মোট বর্জ্যরে ১২ শতাংশ। অপর দিকে পেপার ও পেপার জাতীয় পদার্থ ১৭ শতাংশ কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত করে। বাকি ১৪ শতাংশ কঠিন বর্জ্য আসে অন্যান্য সকল উৎস থেকে।
কঠিন বর্জ্য অপসারণ একটি বড় সমস্যা, যার সঠিক সমাধান হলো উৎপাদিত বর্জ্যরে উৎপাদন উৎস ও প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা করা। এই কাজটি সকল দেশ সফলভাবে মোবাবেলা করতে পারে না। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমূহ। বর্জ্য যেমন ভিন্ন ধরনের তেমনি এর নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াটিও বৈচিত্র্যময়। যেমন, কিছু, বর্জ্য দহনযোগ্য। কিছু বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এর মাঝে রয়েছে প্লাস্টিক পণ্য, কাচের আইটেম, হার্ডওয়্যার, কাঠের পণ্য ইত্যাদি। পচনশীল এবং কিছু অপচনশীল বর্জ্য এবং তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য মাটি পচার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে করোনা বর্জ্য। করোনা বর্জ্য বলতে এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও এ থেকে রেহাই পেতে আমরা বিভিন্ন প্রকার উপকরণ ব্যবহার করছি, যেমন মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজারের বোতল, যা ব্যবহারের পর একটি বৃহৎ পরিমাণ কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে এইসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও একটি বড় হুমকি হয়ে আছে। করোনাকালীন সময়ে শুধু চীনের উহানের হাসপাতালে ২৪০ টন মাস্ক ও পিপি বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে এবং সিঙ্গাপুরে ১৪০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি করোনা চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতিজন রোগী ১.৬৩-১.৯৯ কেজি কঠিন চিকিৎসা বর্জ্য উৎপন্ন করেছে, যা ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন কঠিন বর্জ্য কীভাবে সমস্যা থেকে হতে পারে সম্ভাবনা। আমরা দৈনন্দিন জীবনে উৎপন্ন অধিকাংশ কঠিন বর্জ্যই অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছুড়ে ফেলি। আমাদের এই ফেলে দেওয়া কঠিন বর্জ্যগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট করেছে পরিবেশ, উৎপন্ন করছে বিভিন্ন প্রকার রোগ-জীবাণু, ড্রেন, খাল নদী-নালায় আটকে তৈরি করছে জলাবদ্ধতা। কিছু কিছু কঠিন বর্জ্য হতে উৎপন্ন হচ্ছে দুর্গন্ধ, বিকিরিত হচ্ছে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি, যা পরিবেশ এবং মানবদেহ উভয়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আবার প্লাস্টিক, পলিথিন, কাচ জাতীয় পদার্থ মাটি দূষণের জন্য দায়ী, যার ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। এই সকল সমস্যার জন্যই দায়ী হচ্ছে কঠিন বর্জ্য। কিন্তু আমরা যদি এই সকল বর্জ্যরে উৎপাদন সম্পর্কিত ধারণা রাখতে পারি তাহলে সহজেই এর উৎস এবং গঠন সম্পর্কে বুঝতে পারবো। এতে করে গঠন ও উৎপত্তি অনুসারে আলাদা আলাদাভাবে এই সকল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব। আবার সঠিক ধারণা থাকলে প্লাস্টিক, পলিথিন, কাচ, কাঠ, ইলেক্ট্রনিক্স কঠিন বর্জ্যগুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং মেরামতের মাধ্যমে নতুন পণ্য তৈরি করা যায়। শুধু তাই নয় উৎপাদন সম্পর্কিত সঠিক ধারণাই পারে কঠিন বর্জ্যরে উৎপাদন হ্রাস করতে। আবার জৈব কঠিন বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জৈব স্যার উৎপাদন করা যায়। যার ফলে পরিবেশকে সুন্দর রাখা যায়। অপরদিকে পুনর্ব্যবহার, মেরামতের মাধ্যমে ব্যায় হ্রাস, বর্জ্যরে পরিমাণ হ্রাস করা যায়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কঠিন বর্জ্যরে সমস্যা সমাধানের জন্য বর্জ্যরে উৎপাদন হ্রাস এবং উৎপাদিত বর্জ্যের থেকে উৎস অনুসারে বর্জ্য আলাদাকরণের মাধ্যমে তা পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কঠিন বর্জ্যরে উৎপাদন সম্পর্কিত সঠিক ধারণা অর্জনের বিকল্প নেই। এখনই সুযোগ এবং উৎকৃষ্ট সময় কঠিন বর্জ্য নামক সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করার।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।