বিভিন্ন ধর্মে কোরবানি
পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে
সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে যে সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা অস্তিত্ব লাভ করে তাই সভ্যতা। পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর মধ্যে ইসলামি সভ্যতা অন্যতম। ইসলাম ধর্মের আগমনের মধ্য দিয়ে এ সভ্যতার উৎপত্তি। ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির জনক হলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা)। পবিত্র চিন্তা-চেতনা ও যুক্তির উপর ভিত্তি করেই ইসলামি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ইসলামেই প্রকৃত সভ্যতা ও সংস্কৃতি লুকিয়ে রয়েছে। তরুণ সমাজসহ বিশ্বের জ্ঞান অন্বেষীদের জন্য ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামি সভ্যতায় জাতিগত বৈষম্য, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির স্থান নেই। এটি কোনো বিশেষ জাতি বা শ্রেণির সাথে সম্পর্কিত নয়। ইসলামি সভ্যতা হচ্ছে জীবন্ত ও গতিময় এক সভ্যতা, যা সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ইসলামি সভ্যতার ন্যায় এত বিস্ময়কর সভ্যতা দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাত তাহলে ইসলামি সভ্যতা আরব ভূখন্ডের গন্ডি পেরোতে সক্ষম হতো না। এসব গুণের ফলেই ইসলাম এক শতাব্দীরও স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির ফসল হচ্ছে সভ্য সমাজ। প্রতিটি মানুষের চারিত্রিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সভ্য সমাজ প্রয়োজন। যে সমাজ সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি, মানবকল্যাণ ও মর্যাদার কথা ভাবে, মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য দেয় সেই সমাজই সভ্য সমাজ। সুস্থ ধারার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে গতিশীল করা সম্ভব।
সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারণা ও চেতনা : সভ্যতা হচ্ছে উন্নত সংস্কৃতি। যখন কোন সংস্কৃতি অগ্রগতির কোন এক স্তরে উপনীত হয়, তখন সে সংস্কৃতি সভ্যতার রূপ ধারণ করে। ইংরেজি ঈরারষরুধঃরড়হ শব্দের বাংলা অর্থ সভ্যতা যার উৎপত্তি ল্যাটিন ঈরারঃধং হতে; যা দ্বারা নগর বা নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যকে বুঝানো হয়। মানুষ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দ্বারা জীবন প্রবাহে মানোন্নয়ন ঘটালে তা সভ্যতা নামে পরিচিতি লাভ করে। সংস্কৃতি হলো সভ্যতার বাহন বা বিষয়বস্তু। প্রতিটি সভ্যতা সংস্কৃতিকে লালন করে। মুসলিম সংস্কৃতির অঙ্গ হলো ইবাদাত যা মুসলিম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেমন নামায একটি ইবাদাত। নামায আদায়ের জন্য কেবলা, পবিত্র স্থান, পবিত্রতার জন্য পানি, নামায পরিচালনার জন্য ইমাম, নারী-পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, আযানের জন্য স্থান ইত্যাদি প্রয়োজন। এগুলো ইসলামি সংস্কৃতি যা সঠিকভাবে পালনের জন্য একটি স্থান বাছাই করা হয় যার মালিকানা কোনো ব্যক্তি না হয়ে আল্লাহর মালিকানা করে সকল তাওহীদবাদীকে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়, যাকে আমরা মসজিদ বলে থাকি। এ মসজিদকে কেন্দ্র করেই ইসলামি সভ্যতা গড়ে ওঠে। প্রতিটি দেশের মসজিদগুলো ইসলামি সভ্যতার প্রতীক।
মানুষের প্রয়োজনেই সংস্কৃতির সৃষ্টি। যে সংস্কৃতি ইসলাম সমর্থন করে তা হলো ইসলামি সংস্কৃতি এবং যা ইসলাম সমর্থন করে না তা হলো অপসংস্কৃতি। যেমন ইসলামি গান-কবিতার প্রয়োজনে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি লিখেছেন ‘মসনবি’ (দ্বিপদী কবিতা), ওমর খাইয়াম লিখেছেন ‘রূবাই’ (চতুষ্পদী কবিতা), হাফিজ লিখেছেন গযল (প্রেমের কবিতা), ‘সাবউল মুয়াল্লাকা’র অন্যতম কবি লাবিদ ইসলাম গ্রহণ করে জাহেলি কবিতা ছেড়ে ইসলামি কবিতা লেখা শুরু করেন, এভাবে শেখ সাদী ‘গুলিস্তান’ ও ‘বোস্তান’ নামে নীতিশাস্ত্র রচনা করেন। ফেরদৌসি ইরানের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরে দীর্ঘ ৩০ বছরে লিখেছেন অমরকাব্য ‘শাহনামা’। ইসলামে কোরআনকে সুন্দর হরফে লেখার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে আরবি ক্যালিগ্রাফি। সত্য-মিথ্যা হাদিসের বিশ্লেষণে গড়ে ওঠে রিজালশাস্ত্র, কোরআন-হাদিসের হুকুম-আহকাম, আখলাকের নীতিমালার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে ফিকাহ্ ও উসূলে ফিকহ্। এসবই ইসলামি সংস্কৃতির একেকটি দিক। এ দিকগুলো এক সময় কোরআনের মলাটে গ্রন্থিত হলো, হাদিসের কিতাবে রূপ লাভ করল, হাজার হাজার মাসয়ালায় ফিকাহ্ বিভিন্ন কিতাবে রূপ নিল, কবিতার গ্রন্থ হলো, কাব্য জগতে চলে আসলেন রোদাকী, ফেরদৌসি, সাদী, হাফিজ, খাইয়াম নামে বহু কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের লেখনী রাখার জন্য বায়তুল হিকমার প্রয়োজন হলো। এ সবই ইসলামি সংস্কৃতির দলিল।
মানুষের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা ও লেখনীর মাধ্যমে সভ্যতার উৎকর্ষের শুরু। শিক্ষাক্ষেত্রে সভ্যতা অনুশীলনের ফলে কলমের কালির রং কখনো কালো, কখনো সাদা, কখনো লাল এভাবে বিভিন্ন রংয়ের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে সভ্যতার উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়। এক সময় কালো বোর্ডে লিখতে সাদা চক ব্যবহৃত হত যা এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে সাদা বোর্ডে কালো মার্কার কলম ও কালো বোর্ডে সাদা মার্কার কলম এবং কি-বোর্ডে সাদা-কালো অক্ষর বাটন- এ সবই সভ্যতার বিকাশ। সংস্কৃতির চেয়ে সভ্যতা অনেক বড়। এটি একটি জটিল সংখ্যাগরিষ্ঠ যা অনেকগুলো জিনিস থেকে তৈরি হয় যার মধ্যে একটি দিক হলো সংস্কৃতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর নৃতত্ত¡বিদদের মতে, প্রথমে সংস্কৃতি এবং পরবর্তীকালে সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতি একটি সভ্যতার মধ্যে বিদ্যমান। বহু সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। সংস্কৃতি ছাড়া সভ্যতা সম্ভব নয়।
জীবনের উন্নতির স্তরকেই সভ্যতা বলা হয়। সভ্যতা নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, যোগাযোগ প্রণালি, স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের গুণাবলি দিয়ে বৈশিষ্টিমন্ডিত। সভ্যতায় রয়েছে ক্রমবিবর্তনমূলক জীবনপ্রণালি। এতে আরো রয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার পদ্ধতি, ভাষা, ধর্ম ও শিক্ষা, সংস্কৃতিও ক্রিয়াশীল। সুমেরীয় ও মিশরীয় থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল সভ্যতারই নিজস্ব লিখন পদ্ধতি ছিল। এ লিখন পদ্ধতির মাধ্যমেই জ্ঞানের আহরণ, সঙ্কলন ও সংরক্ষণ করা হতো। এগুলো সভ্যতার মূল ভিত্তি।
সাধারণভাবে কোনো জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞানই হচ্ছে সংস্কৃতি। ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার-আচরণ, সংগীত, চিত্রকলা, শিল্পকলাও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা।’ মূলত সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রণালি এবং সভ্যতা হলো সে জীবনপ্রণালির বাহ্যিক রূপ। সভ্যতা বিকাশের পূর্বশর্ত সংস্কৃতি। সংস্কৃতি টিকে থাকার মাধ্যমে সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে ও বিকশিত হয়।
প্রাচীন ইরানের সংস্কৃতি একটি উন্নত সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ এ সংস্কৃতি ধারণ করে নিজেদের বিকাশ ঘটিয়েছেন। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষকে একটি কাঠামোর নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়। সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম, ধর্ম, দর্শন, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও আইন হচ্ছে মানুষের এ কাঠামোর স্বরূপ। সামাজিক কাঠামো সকল মানুষের জন্য প্রায় অভিন্ন। তাই এ কাঠামোকে বলা যেতে পারে ‘সাংস্কৃতিক কাঠামো’। বিজ্ঞান-সাহিত্য, জ্ঞান-দর্শন ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ অর্থই হচ্ছে সংস্কৃতি। তবে কোন গোত্র বা জাতির বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য, কর্ম ও অবদানসমূহের অর্থেও সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রত্যেক মানুষেরই সংস্কৃতি রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির পার্থক্যও লক্ষ্যণীয়। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি মূলত মানুষের বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনারই প্রতিফলন, যা মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই সূচিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই মানুষ মানসিক ও আধ্যাত্মিক আনন্দ উপভোগ করে।
এক সংস্কৃতি অন্য কোনো সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব বিনিময় হয়। প্রাচীন ইরানের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির মিশ্রণ ও আদান-প্রদান ঘটেছিল। মানুষের ইতিহাস হচ্ছে সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে দেওয়ার ইতিহাস। এক এলাকার সংস্কৃতি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গুণের কারণে দ্রুত অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, ইরানে ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠার পর ইরানিদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ইরানি সংস্কৃতি অতি দ্রুত অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা।
আধুনিক জগতে রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ধ্যান, ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, পোশাক, খাদ্য, খেলাধুলা, শিল্প অর্থাৎ সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ভাবনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তিও বেড়ে যায়। কিন্তু অনুন্নত ও বিপদসংকুল বলে প্রাচীনকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সীমাবদ্ধ। তাই সেকালে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তবুও তৎকালীন যেসব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সংযোগ ঘটেছিল, সেখানেই সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকালে এ সাংস্কৃতিক প্রভাব কখনও শান্তিপূর্ণভাবে এবং কখনও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঘটেছিল।
নাৎসি জার্মানি তাদের সংস্কৃতি জোরপূর্বক পোলান্ডসহ কয়েকটি দেশের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আবার একই উপায়ে দূর প্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহে নিজ সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল জাপান। অবশ্য এ ধরনের প্রচেষ্টা প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে হিন্দু-মুসলিম দুই সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে পাশাপাশি অবস্থান করেছিল। এদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকলেও মূল পার্থক্য ছিল ধর্ম। ফলে এক পর্যায়ে এসে এরা পৃথক হয়ে যায়। এভাবে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে।
ইতিহাসের বিচারে কোনো জাতিই এককভাবে সমুদয় সংস্কৃতির ধারক হতে পারে না। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো অঞ্চলের বিশেষ কোনো জাতি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্ব রেখেছে- যেমন, প্রাচীনকালে মিশরীয়রা তৈরি করেছিল পিরামিড, প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা মানব সভ্যতার কাছে উপস্থিত করেছিল আইন সংকলন। কনফুসিয়াস ও গৌতমবুদ্ধ নৈতিকতার দর্শন নিয়ে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রকে আলোড়িত করেছিলেন। আধুনিক কালে ককেশীয়রা রাজনীতি ও বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে আধিপত্য বিস্তার করেছে। মঙ্গোলীয় ও নিগ্রো জাতি-গোষ্ঠীও বর্তমানে বিশ্বের উন্নয়নের গতিধারায় নিজেদের সফল সংযুক্তি ঘটিয়েছে।
কোনো জাতির উন্নয়নের জন্য সভ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাচীন ও বর্তমানের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে অঞ্চল ভেদে পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। সভ্যতার যাত্রা প্রথম কোথায় শুরু হয়েছিল, সভ্যতা নির্মাণে মানুষ প্রথম কীভাবে ভূমিকা রেখেছিল, তার চিন্তার জগতটি কেমন ছিল তা নির্ণয় করা কঠিন। মানব সভ্যতার আদি মানব নিজ অসহায়ত্বকে অতিক্রম করতে চেয়েছে। জীবনের আরাম-আয়েশ, স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে গিয়ে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সাথে যুক্ত করেছে। মানুষের এই কর্ম প্রচেষ্টা ও সৃষ্টিশীলতার মধ্য থেকে যা উন্মোচিত হয় তাই সভ্যতা।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক বিধি-বিধান ও শিক্ষা প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্য দিয়েই সভ্যতার বিকাশ লাভ করে। কোনো এলাকায় যখন কোনো জাতি-গোষ্ঠী নগর পত্তন করে, উন্নততর জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলে, তখন এর অগ্রগতির সহায়ক হিসাবে লিখন পদ্ধতি, আইন, সরকার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মীয় দর্শন ইত্যাদি উদ্ভাবিত হয়, তখনই তাকে সভ্যতা বলে।
ফারহাঙ্গে উমিদ অভিধানের প্রণেতা হাসান উমিদ সভ্যতা শব্দের অর্থ হিসাবে বলেছেন, নগরবাসী হওয়া, শহরে বসবাসে অভ্যস্ত হওয়া, সামাজিক জীবন-যাপন, একে-অপরের সাথে জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, স্বীয় প্রশান্তি বা জিনিসপত্রে উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি। বিভিন্ন পন্ডিত ও চিন্তাবিদগণ সভ্যতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। লুইস মর্গান ও এডওয়ার্ড টেলর এর মতে বর্বরতা ও বন্যতার পর মানুষের অগ্রগতির পর্যায় হচ্ছে সভ্যতা। চেস্টার জি. স্টার বলেন, প্রথমত, দেয়াল ঘেরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমৃদ্ধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, দ্বিতীয়ত, সামাজিক শ্রেণি, তৃতীয়ত, পরস্পর নির্ভরশীল ব্যবসায়ী, কৃষক, পেশাজীবী শ্রেণির অস্তিত্ব সবশেষে শিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তির উন্মেষ ঘটলে সেখানে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অভিন্ন মনে করেছেন। কোনো জাতি বা দেশের উন্নয়ন পর্যায়ে পৌঁছলে তাকে সংস্কৃতি বলে। উচ্চ পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর কোন জাতি বা দেশ যখন সাংস্কৃতিক বিকাশ লাভ করতে পারে না, তখন সংস্কৃতি ক্রমশ সভ্যতায় উপনীত হয়। কাল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে সভ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের মতে, অর্থনীতিই সকল সভ্যতার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে। উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যবস্থা- এই তিনটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির রূপ সভ্যতার ধরন ও ধারাকে পরিচালিত করে। আর্নল্ড জে. টয়নবির পৃথিবীর ইতিহাসকে সংস্কৃতির একটি উত্তরাধিকার বলে মনে করেন। তাঁর মতে, একটি বিশেষ প্রতিবন্ধক বা সমস্যার মোকাবিলা করতে সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতি যখন উন্নতির পর্যায়ে পৌঁছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অগ্রগতি সাধিত হয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে তখন তাকে সভ্যতা বলে। প্রাচীনকালে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী এলাকায় মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, নীলনদ এলাকায় মিশর সভ্যতা, সিন্ধু এলাকায় সিন্ধু সভ্যতা এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পারস্য, হিব্রু, হিট্টাইট ও ফিনিশীয় সভ্যতা গড়ে ওঠে। এরূপ অন্যান্য সভ্যতার মধ্যে রয়েছে রোমান সভ্যতা, সমৃদ্ধ গ্রীক সভ্যতা, আজটেক সভ্যতা, মায়া সভ্যতা ও চীন সভ্যতা। প্রফেসর লীন থর্নডিক (Professor Lynn Thorndike) তাঁর A Short History of Civilization গ্রন্থে বলেছেন, সভ্যতা হচ্ছে মানুষের উন্নততর মেধার প্রকাশ, মেধাবী ব্যক্তির মৌলিক চিন্তা ও চেষ্টার মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু এবং পরবর্তীতে দলবদ্ধ মানুষ তা ধারণ করে ও এগিয়ে নিয়ে যায়।
ইংরেজ ঐতিহাসিক হেনরি টমাস বাকল (Henry Thomas Buckle) মনে করেন, মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তি। ঐতিহাসিক রালফ ওয়ালডো ইমারশন (Ralph Waldo Emarson)-এর মতে, সভ্যতার অর্থ হচ্ছে অগ্রগতি। আধুনিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel) এর মতে, সভ্যতা হচ্ছে মানুষের সার্বিক অগ্রগতি এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞগণের বক্তব্য থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের মেধা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জীবন ব্যবস্থা, আইন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই সভ্যতার জন্ম। মানুষের ধারাবাহিক চেষ্টা ও কর্মধারার ফল হিসাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে তার জীবনধারা ও চিন্তার ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় সভ্যতার ধারকরূপে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ, রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক বিধি-বিধান ইত্যাদি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সভ্যতার চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতাগণ মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবন ধারার উন্নয়ন সাধন করেছিলেন এবং মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রাচীনকালে এক পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে এ যোগাযোগ ত্বরান্বিত হয়। ফলে উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে অনুন্নত সভ্যতা দীপ্তিমান হয়ে ওঠে। উন্নত চিন্তা-ভাবনা ও কলা-কৌশল আয়ত্ত করে বিভিন্ন সভ্যতা নিজেদেরকে আরও উন্নততর করে তোলে। সে ফসল আধুনিক সময় পর্যন্ত এসে আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে তুলেছে।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব: বিশ্বে যাদেরকে সভ্যতার প্রতিভূ বলে মনে করা হয় তারাই এখন এর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বর্তমানে মানবসভ্যতা স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীলতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বর্তমানে সাফল্য দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান জি-সেভেন নামে যা করছে তা মানবসভ্যতার গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। ন্যাটোবাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গণহত্যা ও আগ্রাসী যুদ্ধের কাজে। বিশে^র ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোও উন্নতবিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষ্যে ইতিবাচক নয়। বরং অনাকাক্সিক্ষত লেজুড়বৃত্তির বৃত্তেই আটকা পড়েছে। সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ও চিন্তাবিদগণ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। ফলে আমাদের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জাতীয় জীবনে। ফলে আমাদের সংস্কৃতি অপসংস্কৃতিতে রূপান্তর হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধ ও সমস্যা রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে সমাধান হচ্ছে না। শাসকশ্রেণি অপসংস্কৃতির আলোকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছে। সমাজে কোনো ক্ষেত্রেই প্রকৃত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ফলে হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, অত্যাচার ও নির্যাতনের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ ও দুর্নীতির সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি, নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতন এবং পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে। সভ্যতার বিকাশের ফলে মানুষ আগুন ও পানিকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র গঠন, এমনকি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মানুষের রয়েছে নৈতিক চেতনা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধি। মানুষের বিবেক রয়েছে। বিবেক ও সত্য এবং ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতি রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সভ্যতার ক্রমবিকাশ মানুষের হাতে হলেও তা কলঙ্কিত হচ্ছে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়ে গেছে। আগুন, পানি ও প্রকৃতির ব্যবহার বৃহৎ শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে, প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন ক্রমবর্ধমান। সমুদ্রে পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিনিয়ত পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে নষ্ট করা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতা ও ধ্বংসের পথকেই সমর্থন করছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা করছে তারা অন্ধকারের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইসলামি সভ্যতার অবদান: ইসলামি সভ্যতা যে বিশ্বের উন্নতির আবিষ্কার ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অপূরণীয় অবদান রেখেছে তা এক ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারে মুসলিম জাতির ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে না পাওয়ার ফলে মুসলিম তরুণ ও যুবকরা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। আজ আমরা মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদানের কথা বিস্মৃত হচ্ছি। ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রথম ভূ-মানচিত্র যাঁরা এঁকেছিলেন তাঁরা সবাই মুসলিম ছিলেন। ৬৯ জন মুসলিম ভূগোলবিদ পৃথিবীর প্রথম যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তার নাম ‘সুরাতুল আরদ’ যার অর্থ হচ্ছে বিশ্ব আকৃতি। ইবনে ইউনুসের অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা মন্ডল নিয়ে গবেষণার ফলকে ইউরোপ মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল। তাছাড়া মুসলিম ফরগানী, বাত্তানী, আল খারেজমি প্রমুখের ভৌগোলিক অবদান অবিস্মরণীয়। এছাড়াও কম্পাস যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন ইবনে আহমদ। পানির গভীরতা ও স্রোত মাপার যন্ত্র মুসলিম বৈজ্ঞানিক আব্দুল মজিদ আবিষ্কার করেছিলেন। মুসলিম বৈজ্ঞানিক আলকিন্দি বিজ্ঞানের উপর ২৭৫টি গ্রন্থ লিখেছিলেন। প্রাচীন মুসলিম বৈজ্ঞানিক হাসান, আহমদ, মুহাম্মাদ সম্মিলিতভাবে ৮৬০ সালে বিজ্ঞানের একশ প্রকারের যন্ত্র তৈরির নিয়ম ও ব্যবহার প্রণালি এবং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন। বর্তমান বিশ্বে বিবর্তনবাদ ও বিবর্তনবাদের জনক বলে যে চার্লস ডারউইনের কথা উল্লেখ করা হয়, সেই পশু-পাখি, লতা-পাতা নিয়ে ডারউইনের পূর্বেও যিনি কাজ করেছেন তিনি ছিলেন মুসলিম বৈজ্ঞানিক আল আসমাঈ। মুসলিমরা চিনিও আবিষ্কার করেছিলেন। ভূতত্ত¡ সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুজাম আল উবাদা’ এর লেখক হচ্ছেন মুসলিম ইয়াকুব ইবনে আব্দুল্লাহ। তুলা থেকে মুসলিম আবিষ্কারক ইউসুফ ইবনে উমার প্রথম তুলট কাগজ আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের ২ বছর পর বাগদাদে কাগজের কারখানা তৈরি করা হয়েছিল। মুসলিম বিজ্ঞানী জাবীর ইবনে হাইয়ান ইস্পাত, ধাতুর শোধন, তরল বাষ্পীকরণ, কাপড় ও চামড়া রঙ করা, ওয়াটার প্রুফ তৈরি করা, লোহার মরিচা প্রতিরোধক বার্নিশ, চুলের কলপ, লেখার পাকা কালি আবিষ্কার করেন। ম্যাঙ্গানিজ-ডাই-অক্সাইড থেকে মুসলিম বিজ্ঞানী আর রাযি প্রথম কাচ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মীয় পন্ডিত, গণিতজ্ঞ ও চিকিৎসাবিশারদ। পারদ, গন্ধক, আর্সেনিক ও সালমিয়াক নিয়ে তাঁর গবেষণা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে প্রথম পানি জমিয়ে বরফ তৈরি তাঁরই অক্ষয় কীর্তি। গণিত ও চিকিৎসাবিশারদ ওমর খাইয়াম পৃথিবীখ্যাত ও সর্বজনবিদিত। তাছাড়া সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে নাসির উদ্দিন তুসী ও আবু সিনার অবদান ব্যাপক। পৃথিবীর প্রথম মানমন্দিরের আবিষ্কারক ছিলেন হাজ্জার ইবনে মাসার এবং হুনাইন ইবনে ইসহাক। পৃথিবীর প্রথম মানমন্দির তৈরি হয় ৭২ খ্রিস্টাব্দে, ২য়টি ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে। ২য় মানমন্দির জন্দেশপুরে, ৩য়টি বাগদাদে এবং ৪র্থটি দামেস্কে। তা তৈরি করেন মুসলিম খলিফা আল মামুন।
পৃথিবীর প্রথম বীজগণিতের জন্মদাতা মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খারেজমি ছিলেন। তিনি ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামে ভারত সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। শূন্যের মূল্য অমূল্য ও অপরিসীম, এই শূন্য (০)ও তিনি আবিষ্কার করেছেন। ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মোকাবেলা’ গ্রন্থটি তাঁর অবদান। শুধু তাই নয়, তিনি জ্যোতির্বিদও ছিলেন। খলিফার অনুরোধে আকাশের মানচিত্রও তিনি এঁকেছিলেন এবং একটি পঞ্জিকার জন্ম দেন। তাঁকে সরকারি উপাধি দেয়া হয়েছিল ‘সাহিব আলজিজ’। মুসলিম ঐতিহাসিকদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মুসলিম ঐতিহাসিকগণই ভারতীয় ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তবে এ ক্ষেত্রে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের অবদানও কম নয়। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ইতিহাসের স্রষ্টা মুসলিম এবং অনুবাদক ছিলেন ইংরেজ। এসব মুসলিম ঐতিহাসিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আলবিরুনী, ইবনে বতুতা, আলিবিন হামিদ, বাইহাকী, উৎবী, কাজী মিনহাজুদ্দিন সিরাজ, মহিউদ্দিন, মুহাম্মদ ঘোরী, জিয়া উদ্দিন রারণী, আমীর খসরু, শামসী সিরাজ, বাবর, ইয়াহিয়া বিন আহমদ, জওহর, আব্বাস শেরওয়ানী, আবুল ফজল, বাদাউনি, ফিরিস্তা, কাফি খাঁ, মীর গোলাম হুসাইন, হুসাইন সালেমি, সাইদ আলী প্রমুখ। তাঁদের লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ হলো ‘তারিখই সিন্ধু’, ‘কিতাবুল ইয়ামিনি’, ‘তারিখ-ই মাসুদী’, ‘তারিখ-ই ফিরোজশাহী’, ‘তারিখুল হিন্দ’, ‘তাবাকাত-ই-নাসিরি’, ‘খাজেনুল ফতওয়া’, ‘ফতওয়া উস সালাতিন’, ‘তারিখে মুবারকশাহী’, ‘তারিখে সানাতিনে আফগান’, ‘তারিখে শেরশাহী’, ‘মাখজানে আফগান’, ‘আকবর নামা’, ‘আইনি আকবর’, ‘মুততাখাবুত তাওয়ারিখ’, ‘মুন্তাখাবুল লুবাব’, ‘ফুতুহুল বুলদান’, ‘আনসাবুল আশরাফ ওয়া আখবারোহা’, ‘তারিখে ইয়াকুব’, ‘তারিখে তাবারী’, ‘আখবারুজ্জামান’, ‘মুরুজুজ জাহাব’, ‘তামবিনুল আশরাফ’, ‘উসদুল গাবাহ’, ‘আখবারুল আব্বাস’ ইত্যাদি।
সভ্যতার সঙ্কট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরা মুক্ত নই। দেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা, বিরাজনীতিকরণ ও বিরাষ্ট্রকরণ কার্যক্রম প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী হচ্ছে না। সংবিধান অনুযায়ী দেশ ও সমাজ পরিচালিত হচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থায় প্রশাসনের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সাথে রয়েছে রাজনীতির নিবিড়তম সম্পর্ক। রাজনীতিতে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার কাঠামো শক্তিশালী না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে হয় অকল্যাণ। তখন রাজনীতি অপরাজনীতিতে রূপ লাভ করে। ফলে সমাজে ন্যায্যতা ও মূল্যবোধ নষ্ট হয়। কোনো ব্যক্তির মূলবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি হয় একজনের কিন্তু শাসকশ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
উপসংহার: ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতায় পার্থিব জীবন ও ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককেই গুরুত্ব দেয়। ধর্ম হচ্ছে মানুষের উন্নতি ও পূর্ণতা সাধনের মাধ্যম। জ্ঞান বিবেকের সাথে ইসলামের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সাথে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের ফলে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে। মুসলিম সভ্যতা অতীত সভ্যতাগুলোর নেতিবাচক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে লালন করে পূর্ণতা ও বিকশিত হয়েছে।
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির ইতিহাস এক ও অভিন্ন নয়। কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিল রয়েছে। তাই সভ্যতার সংকট মোকাবেলায় বহুজাতিক ঐক্যের আবশ্যকতার বিষয়টি অপরিহার্য। তবে সে ক্ষেত্রে কোনো জাতিরই নিজস্ব সঙ্কটকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির উপর নির্ভরশীল থাকাও উচিত নয়। সেক্ষেত্রে নিজ নিজ সমস্যা নিজ উদ্যোগেই সমাধান করে নেওয়া উচিত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক সরকারের ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত থাকে নি। চীন ও রাশিয়া মাঝে মাঝে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করছে যদিও তা পর্যাপ্ত নয়।
সভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠায় ন্যায্যতা, মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে ন্যায্যতা, মূল্যবোধ লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই সমাজে নাগরিকদেরকে নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের চর্চা, সুস্থ ধারার সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবেই সভ্যতার উৎকর্ষতাকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সমাজে সুশিক্ষার বিকল্প নেই। যখন কেউ সুশিক্ষিত হন তখন তাঁর মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সৃষ্টি হয়। তখন সে ব্যক্তি হয়ে ওঠেন সংস্কৃতিবান। তিনি তখন নিজেকে অবক্ষয়মুক্ত এবং নিজ শিক্ষাকে সৎ ও ন্যায়ের পথে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেন।
সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি, অবক্ষয় ও সভ্যতার সঙ্কটের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, পারস্পরিক মূল্যবোধের অভাব। ধর্মের প্রকৃত চর্চা ও অনুশীলনে ধর্মান্ধতা নেই; বরং ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ধর্মীয় আদর্শের প্রয়োজন। ধর্মই মানুষকে সভ্য, পরিশীলিত, সংবেদনশীল করেছে। ধর্ম কখনো সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের পথে অন্তরায় নয়। ধর্মকে আশ্রয় নিয়েই পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে; ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে নয়। একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি এবং অবক্ষয়হীন সমাজ সৃষ্টি করতে হলে দেশের নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলনের বিকল্প নেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।