পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দৈনিক ইনকিলাবের যশোর ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা মিজানুর রহমান তোতা আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। গতকাল ভোরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গত ৩ জুলাই বিকালে স্ট্রোক করলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর দেখে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করান। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বেশকিছু দিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। গত শুক্রবার রাতে তার অবস্থার অবনতি হয়। অক্সিজেন লেভেলও মারাত্মকভাবে কমে যায়। সকল চিকিৎসা ব্যর্থ করে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মিজানুর রহমান তোতার মৃত্যুতে মফস্বলসহ গোটা সাংবাদিক জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সৎ, দক্ষ, অনুসরণীয় ও অনুকরনীয় এমন সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে সাংবাদিকতায় অপূরণীয় ক্ষতি ও শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা সহসা পূরণ হওয়ার কথা নয়। তার মৃত্যুতে দৈনিক ইনকিলাব পরিবার গভীরভাবে শোকাহত।
মিজানুর রহমান তোতার জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদরের হরিপুরে। কর্মজীবনের শুরু থেকে তিনি যশোর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে তিনি মাঠ সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি পর্যায়ক্রমে গণকণ্ঠ, দৈনিক স্ফুলিঙ্গ, দৈনিক ঠিকানা, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। সবশেষ তিনি দৈনিক ইনকিলাবের যশোর ব্যুরো চীফ ও বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ইনকিলাবের সাথে তার সম্পৃক্ততা ৩৪ বছরের। ইনকিলাবের নীতি-আদর্শের সাথে একীভূত হয়ে তিনি মফস্বল সাংবাদিকতাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন মাঠ সাংবাদিক। সাংবাদিকতাকে গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত নিয়ে যেতে তিনি হেঁটে বেড়িয়েছেন হাটে-মাঠে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সাথে একনিষ্ঠভাবে মিশে তাদের সুখ-দুঃখ, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা গভীর মমতায় তুলে এনেছেন। বলেছেন মাটি ও মানুষের কথা। যেখানেই সমস্যা দেখেছেন সেখানে ছুটে গেছেন। তুলে ধরেছেন অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা। তাকে বলা যায় মাটি ঘেঁষা দরদী, সচেতন এবং পেশার প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ আন্তরিক একজন অনন্য সাধারণ মানুষ। মাটি, মানুষ, সমাজ ও দেশের প্রতি একজন সাংবাদিকের যে দায়বোধ, কর্তব্য ও দায়িত্ব থাকে মিজানুর রহমান তোতা ছিলেন তার প্রতিভু। মাঠ সাংবাদিকতায় তিনি নিজেকে প্রবাদ পুরুষে পরিণত করেছিলেন। মফস্বলে থেকেও তার কলমের মাধ্যমে উঠে এসেছে জাতীয় পর্যায়ের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য প্রতিবেদন, যা দেশ ও জাতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিক নির্দেশক হয়ে রয়েছে। সাংবাদিকতায় বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি যেমন বিশাল, তেমনি এতে নানা প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসা শুধু কঠিনই নয়, সুকঠিনও বটে। এ কথা মিজানুর রহমান তোতা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমাজের সব অত্যাচার, নির্যাতন, অনাচার, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্দশা, সমস্যা, অসঙ্গতি, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা সুলভ উপায়ে স্বার্থসিদ্ধির নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতেই পেশাটি বেছে নিয়েছি। আমার সাংবাদিকতা জীবন যেমন রঙ্গীন স্বপ্নে ভরপুর, তেমনি অনেক দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছি। রাজ্যের হতাশা এবং স্বপ্নভঙ্গের মতো ঘটনার মধ্যেও সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত হওয়া সুন্দরবনের গাছপালার মতো জেগে উঠেছি। যুক্তিহীনতার ছড়াছড়ির মাঝে যুক্তির সন্ধান করতে পিছু হটিনি। বিশ্বাস করেছি, সামাজিক দায়বোধ থেকে করা সৎ সাংবাদিকতায় সাময়িক আঘাত আসলেও পরাস্ত করতে পারে না। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা বারবার বলেছে, এই পেশা ছেড়ে দাও, এই পেশা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও থেমে থাকিনি, থামেনি গতি।’ সাংবাদিকতার প্রতি তার এই অদম্য মানসিকতা নবীন সাংবাদিকদের জন্য অনুপ্রেরণা ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে মফস্বল সাংবাদিকতার ধরণ বদলে গেছে। মফস্বল সাংবাদিকদের অনেকের পড়াশোনার যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি অনুসন্ধিৎসু এবং সৎ ও প্রকৃত সাংবাদিকতাকে পাশ কাটিয়ে শুধু ধান্ধা-ফিকিরবাজি কারো কারো লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সমস্যা, সম্ভাবনা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার সংবাদ তাদের কাছ থেকে খুব কমই পাওয়া যায়। একজন মুটে-মুজুর, কৃষক বা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ যে কথা বলল তাই লিখে দেয়। গভীর অনুসন্ধান এবং খবরের পেছনের খবর তুলে আনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। মাঠ সাংবাদিকতার যে প্রকৃত ধরণ, স্পৃহা, সাধনা ও উৎসুক্য তা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। অথচ মাঠ ও মফস্বল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মিজানুর রহমান তোতা অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছেন। তার বিচরণ যশোর অঞ্চলে হলেও তিনি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। এর গন্ডি পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পুরো দেশের প্রতিনিধি।
মিজানুর রহমান তোতার মৃত্যুতে মফস্বল সাংবাদিকতার এক দিকপালের অবসান হলো। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই ছিলেন না, শিল্প-সাহিত্যের মতো সৃজনশীল কাজেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। মাঠ সাংবাদিকতার আদ্যপান্ত নিয়ে তার লেখা গ্রন্থটি এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছে অমূল্য দলিল হয়ে থাকবে। নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ক্ষতবিক্ষত বিবেক’ তার সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতার কথায় ঋদ্ধ হয়েছে। এ গ্রন্থ থেকেও মফস্বল সাংবাদিকদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। তিনি একজন নিবন্ধকার এবং কবি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। এ বছর একুশে গ্রন্থমেলায় তার কবিতা গ্রন্থ ‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’ প্রকাশিত হয়েছে। তার জেলা যশোরের সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতির কথা অসংখ্য লেখনির মাধ্যমে তিনি তুলে এনেছেন। সাংবাদিকদের নেতৃত্বেও তিনি ছিলেন একজন ন্যায়-নিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন, অবিভক্ত যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, যশোর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং তিন বারের সভাপতি। এছাড়া যশোর ইন্সটিটিউট ও শিল্পকলা একাডেমীর আজীবন সদস্য। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মিজানুর রহমান তোতা এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন। সাংবদিকতা ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা এবং লক্ষ্যে স্থির থেকে একজন সাংবাদিক হিসেবে যেভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা দেশের সাংবাদিক মহল চিরদিন স্মরণে রাখবে। আমরা মিজানুর রহমান তোতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা জানাই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।