Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২১, ১২:০৬ এএম

ঈদুল আজহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি, যা জিলহজ্ব মাসে পালন করা হয়। এ মাসেই মুসলমানরা পবিত্র হজ্বও পালন করে থাকে। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোক না কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবাণী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ মর্মবাণী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা জোগায়। এ প্রেরণায় উদ্দীপ্ত সমাজের হতদরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মুসলমান হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সময়ে সামর্থ্যবান মুসলমান হজব্রত পালন করে থাকে। হজ্ব একান্তই একটি ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হজব্রত পালন করা হয়। ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, কর্ম নির্ভর ধর্ম। যার কর্ম শুদ্ধ নয়, তার ধর্মও শুদ্ধ নয়। ঈমান পাকাপোক্ত হয় সৎকর্মের মাধ্যমে। সৎকর্মে যারা আজীবন নিবিষ্ট থাকে তারাই সৃষ্টির সেরা। (সুরা বাইয়্যেনাহ ৭)। প্রবৃত্তির দাস কখনও আল্লাহ্র দাসে পরিণত হতে পারে না। ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে মানবতার সেবা এমনভাবে করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেন। (কাসাস ৭৭)। শেখ সাদী (র.) বলেন, ‘তব তসবিহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।’ হজ ফরজ হওয়ার মূলে অপরিসীম আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গুরুত্ব নিহিত রয়েছে যা অনুধাবন ছাড়া হজ করতে যাওয়া নিছক আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পবিত্র কোরআনে এর মূল্যবোধের বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরানোর মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ, কল্যাণ নিহিত রয়েছে যে ঈমান আনে আল্লাহ্র উপর, পরকালে, ফেরেশতাগণ, সব কিতাবে, নবীদের ওপর এবং আল্লাহ্র মহব্বতে দান খয়রাত করে প্রতিবেশীদের জন্য, এতিম, মিশকিন, মুসাফির ও ইবাদতকারীদের জন্য গোলামমুক্ত করার জন্য এবং সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে, অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করে, ধৈর্য্যধারণ করে বিপদের সময়, দুঃখ কষ্ট ও যুদ্ধের সময়, তারাই সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই প্রকৃত মুত্তাকি। (সুরা বাকারা ১৭৭)। পবিত্র এ আয়াতের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আনুষঙ্গিক অন্য দায়িত্ব তথা হক্কুল ইবাদ বা আর্তমানবতার প্রতি অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন ব্যতিরেকে শুধু কেবালামুখী হয়ে, আনুষ্ঠানিক ইবাদত অসম্পূর্ণ। হক্কুল ইবাদ তথা মানবতার হক আদায় ব্যতীত হক্কুুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক আদায় হয় না। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয়, কারও সঙ্গে কারও ভেদাভেদ নয়। ত্যাগের মহিমায় ক্ষুদ্রতা ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের সুযোগ করে দেয় ঈদুল আজহা। আমাদের উচিত ঈদুল আজহার ত্যাগের মহিমা, ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করা, উপলব্ধি করা। ঈদের শিক্ষা হলো মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।

এবারের ঈদও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদযাপন হবে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের মধ্যে গত বছর ঈদুল আজহা পালিত হয়েছিল আর এবার যখন কোরবানির ঈদ আসছে তখন চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, যা আগেরবারের চেয়ে আরও ভয়ানক মনে হচ্ছে। তাই সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনা মহামারি মানুষের যাপিত জীবনে এনেছে বিরাট পরিবর্তন। মানুষের জীবনযাত্রায়ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। করোনা সবকিছু বদলে দিয়েছে। এখন মানুষ ঈদের কোলাকুলি করবে না, মুসাফা করবে না। আগের মতো আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও যাবে না। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো এবং শারীরিক দূরত্ব্ও বজায় রাখবো ঠিকই, কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই ঈদের চেতনাই হলো মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন জোরদার করা। সামাজিক দূরত্বের নামে আমরা যেন মানসিক দূরত্বে জড়িয়ে না পড়ি। অশুভ শক্তি আমাদেরকে যেন অমানুষ করে না ফেলে। সেজন্য আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি সংক্রমণ এড়ানোর জন্য ক্রেতা-বিক্রেতা ও পশুর হাটগুলোর ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করে দরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারে একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আজহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব। ঈদুল আজহা কোরবানি বা ত্যাগের ঈদ। কোরবানী মানে শুধু পশুহত্যা নয়, মনের পশু হত্যা করার। চার হাজার বছরেরও বেশী আগে হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহ্-তায়ালার নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস অর্থাৎ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহ্-তায়ালার অপার কুদরত ও মহিমায় হযরত ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই থেকেই চালু হয় কোরবানিতে পশু জবাই করার বিধান। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহ্র অনুগ্রহ কামনা করে পশু কোরবানি করে। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ফরজ। ঈদের পরের দুই দিনও পশু কোরবানি করা যায়। ঈদ নামায শেষে করতে হয়। কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্যে, আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এক ভাগ এবং গরীব মানুষদের মধ্যে একভাগ বণ্টন করে দেয়া উত্তম।

ইসলাম শব্দের অর্থের সাথে কোরবানির অর্থের মিল খুজে পাওয়া যায়। ইসলাম অর্থই হচেছ আত্মসমর্পণ এবং আত্মসমর্পণ এর অর্থ হচ্ছে আত্মবিসর্জন, আর আত্মবিসর্জন মানেই কোরবানি। রাসুল (আ.) এরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তির কুরবানি করার সামর্থ্য আছে আর সেই ব্যক্তি যদি কোরবানি না করে সে যেন ঈদগাহে না আসে। সামর্থবান মানে যিনি নিছাব পরিমান সম্পদের মালিক হবে তার উপর কোরবানি করা বাধ্যতামূলক বা ওয়াজিব। কোরবানির গুরুত্ব বিষয়ে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন: ‘কোরবানির দিনে কোরবানির চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ্-তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় নয়। কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুর শিং, লোম ও পায়ের খুর সব কিছু নিয়েই আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে। কোরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মহান আল্লাহ্-তায়ালার কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। সুতরাং, তোমরা স্বাচ্ছন্দে কোরবানি কর।’ পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে কোরবানিকৃত পশুর গোশত এবং রক্ত কিছুই আল্লাহ্র কাছে পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া (সুরা: হজ্ব-৩৭) অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে: আল্লাহ তো কেবল মুক্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। সুরা কাওসার এর ২নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে: অতএব তোমার মালিককে স্মরণ করার জন্য তুমি নামাজ পড় এবং (তারই উদ্দেশ্যে) তুমি কোরবানি করো।

কোরবানি হলো পশুর সঙ্গে পশুত্ব কোরবানির নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে অনেকে অনেক মানসিকতায় কোরবানি করে যা সহজেই দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ লোকলজ্জায় নিজে কোরবানি না দিলে সন্তানরা গোশত পাবে কোথায়, আশপাশের অনেকেই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দেই কীভাবে- এ ধরনের মানসিকতায়ও কোরবানি করে। এ ধরনের কোরবানি আল্লাহ তায়ালার দরবারে নাও পৌঁছাতে পারে। তাছাড়া অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিককে কত দামের কোরবানি করবে সে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে দেখা যায়। তাদের কাছে কোরবানি লৌকিক প্রথা হয়ে গেছে। লক্ষাধিক টাকায় গরু বা উট কিনে বাসার গেটের সামনে বেধে রেখে নিজ এলাকায় খ্যাতি অর্জনই অনেকের কোরবানির উদ্দেশ্য বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ ধরনের কোরবানি দ্বারা আত্মত্যাগ হয় না। ঈদুল আজহার দিনে পশু কোরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হোক আমাদের জীবন। তা না হলে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কোরবানি শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কোরবানির মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ্ আমাদের সত্যিকারের কোরবানি করার তৌফিক দান করুন।
লেখক: ব্যাংকার, কলামিস্ট ও গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল আজহা

৯ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন