Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবি

ঐতিহ্য সুরক্ষায় চলছে সামাজিক আন্দোলন

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

পৌনে এক কোটি মানুষের মহানগরী চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসাবে পরিচিত ছায়া-সুনিবিড় শান্তিদানকারি শতবর্ষী বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ বৃক্ষরাজি ও হরেক পাখ-পাখালির বিচরণ ক্ষেত্র প্রকৃতির এক দারুণ মায়াজাল সিআরবি সুরক্ষার দাবিতে সর্বমহলে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। এই গণদাবি পরিণত হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের সামাজিক আন্দোলনে।
পরিবেশ, ইতিহাস, শতাধিক বছরের ঐতিহ্য-সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ ছায়া সুনিবিড় নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল সিআরবি এলাকা। সেখানে হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের মতো পরিবেশ-প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ দাবিতে সিআরবি এলাকায় প্রতিবাদী অবস্থান, প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। সিআরবি এলাকা প্রতিদিনই বিক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তাল।
প্রতিবাদকারীরা বলছেন, নগরীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, ঐতিহাসিক স্থাপনা রেলওয়ে বিল্ডিং, শিশু-কিশোর থেকে প্রবীণদের আড্ডা ও খেলাধুলা এবং পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রধানতম এ স্থানে কংক্রিটের জঞ্জাল গড়তে দেওয়া যায় না। আমরা শ্বাস নিতে চাই, হাসপাতাল বিকল্প স্থানে করতে হবে। তারা বলছেন, হাসপাতাল নির্মিত হলে সেই হাসপাতালকে ঘিরে মানুষ ও যানবাহনের অবাধ চলাচল এবং বর্জ্য নিঃসরণসহ নানা কারণে হুমকির মুখে পড়বে সিআরবি, হারাবে সৌন্দর্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ প্রণীত তালিকা অনুসারে ঐতিহাসিক, নান্দনিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সিআরবির মত জায়গা ও স্থাপনাসমূহকে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এর কোন ব্যতিক্রম চট্টগ্রামবাসী মেনে নেবে না।
নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষার এই আন্দোলনে নেমেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে গতকাল মহানগর নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম সিআরবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ স্বরূপ বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচী পালন করেছে। এতে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, সিআরবি এলাকাটি রেলওয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এটি ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য শৈলীর একটি অনবদ্য নিদর্শন এবং বলা হয়ে থাকে এটিই চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীনতম সুশীতল এলাকা। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বহুতল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের মত স্থাপনা নির্মাণ বাসযোগ্য পরিবেশ বিনষ্ট করবে। সিআরবির এই মহামূল্যবান জমি কী করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। এই জমি বরাদ্দ দেয়ায় রেলের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি।
এসময় মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি. ডা. বেলায়েত হোসেন ঢালী, মিসেস জেলী চৌধুরী, ডা. কাজী মাহবুব আলম, কামরুল ইসলাম, ডা. এস এম সারোয়ার আলম, ডা. ময়নাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আয়েশা আক্তার সানজি, অ্যাডভোকেট আসমা খানম, তাসলিম আহমেদ লিমা, নারীনেত্রী জোহরা বেগম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এর আগে বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র ও শিশু কিশোর মেলার উদ্যোগে সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মেলার সংগঠক ধ্রুব ভট্টাচার্য্যরে পরিচালনায় এ মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন মেলার সংগঠক রিপা মজুমদার, বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রের সংগঠক পুষ্পিতা নাথ. মোহাম্মদ রাসেল, সদস্য আকাশ বড়ুয়া, ব্লাড ফাইন্ডার্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তাপস কান্তি নাথ, অনিরুদ্ধ দেওয়ানজী।
বক্তারা বলেন, চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভ উপেক্ষা করে সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষ সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজ নির্মাণের মতো জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। সরকারি সেবা সংস্থার এ বাণিজ্যিক প্রকল্পের ফলে নগরীর ফুসফুস খ্যাত শত বছরের গড়ে উঠা সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ যে ধ্বংস হবে, এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত মুষ্ঠিমেয় মুনাফালোভী ছাড়া সবার কাছেই তা স্পষ্ট।
সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল লুন্ঠনবৃত্তির অপপ্রয়াস
সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন ও সুরক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভায় বক্তারা সিআরবিতে রেলওয়ের জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যহানীর অপচেষ্টা উল্লেখ করে বলেছেন এটি লুন্ঠনবৃত্তির অপপ্রয়াস। চট্টগ্রাম রেলওয়ের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বক্ষব্যাধি ও ৫০ সাধারণ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। এ হাসপাতালটিকে বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে গড়ে না তুলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পায়তারা মেনে নেয়া যায় না। গতকাল টাইগার পাসস্থ চসিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের সভাপতিত্বে ও সচিব খালেদ মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন কাউন্সিলর মো. মোবারেক আলী, মো. শফিকুল ইসলাম, রুমকী সেনগুপ্ত, ফেরদৌসি আকবর ও নগর পরিকল্পনাবিদ আব্দুল্লাহ আল ওমর। সভায় বলা হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সিআরবির ভূপ্রাকৃতিক উন্মুক্ত স্থানকে কোনভাবে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না। বাণিজ্যিক ও আবাসিক কোন স্থাপনা করা যাবে না।
অনুমোদন দেবে না সিডিএ
সিআরবি এলাকা ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে বন্দরনগরীর মহাপরিকল্পনায় ‘সংরক্ষিত এলাকা’ হওয়ায় সেখানে কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ প্রকল্পের অনুমোদনের জন্য এখনো সিডিএর কাছে আবেদন করা হয়নি। এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সাংবাদিকদের বলেন, মাস্টারপ্ল্যানে এটি হেরিটেজ জোন হিসেবে আছে। আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দেব না। হেরিটেজ জোনে কর্মাশিয়াল কিছু করার সুযোগ নেই। সিআরবি সারাদেশের মধ্যে অন্যতম নান্দনিক স্থান। আমাদের আর কোনো ওপেন স্পেস নেই। তিনি বলেন, যাই বলুক, এখানে হাসপাতাল করতে গেলে অনেক গাছ কাটা পড়বে। একটা হাসপাতাল মুখের কথা না। সিডিএর কাছে আসুক, হাসপাতালের জায়গা আমরা দেখিয়ে দেব, সিআরবিতে নয়।
ইকো ফ্রেন্ডসের মানববন্ধন
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ইকো ফ্রেন্ডসের উদ্যোগে এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা, পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক পরিষদ, ওব্যাট থিংক ট্যাঙ্ক চট্টগ্রাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ফাউন্ডেশন, স্মাইল বাংলাদেশ প্রভৃতি সংগঠনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ সিআরবিতে অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি উত্তম কুমার আচার্য্যরে সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নোমান উল্লাহ বাহারে সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, গণঅধিকার ফোরামের মহাসচিব এম এ হাসেম রাজু, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, ব্যবসায়ী মাহবুব রানা, ইপসার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, সমাজকর্মী নেছার আহমেদ খান, চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শহীদ ফারুকী প্রমুখ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ