পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত মঙ্গলবার আমি বলেছিলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কে বা কারা বিরোধিতা করেছিল এবং কেন বিরোধিতা করেছিল সে সম্পর্কে আজকের কলামে আলোচনা করবো। এ সম্পর্কে প্রথমে আমরা বিবিসির ভাষ্য জানবো। ঐ ভাষ্যে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। বঙ্গভঙ্গের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ছয় বছর। এই ছয় বছরেই পশ্চিমবঙ্গের নেতারা প্রবল আন্দোলন করেন বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য। বঙ্গভঙ্গ রদের সাথে সাথে মুসলমানদের ক্ষোভ ও বঞ্চনা আরো বেশি পুঞ্জিভূত হয়। তাদের বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, অর্থনৈতিক বঞ্চনার সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লেখক আবুল মকসুদ লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বঙ্গভঙ্গের আগে থেকেই মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল। কারণ, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র যে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্রমেও হিন্দু ধর্ম প্রাধান্য পেয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হিন্দুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তাঁর পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আজ যে বিজেপি ভারত শাসন করছে সেই বিজেপির পূর্বসূরী ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মহাসভা।
সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক তৌহিদুল হক বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণীর মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ, তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ বর্ণের কিছু হিন্দু। তাদের সাথে, বিশেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে শিয়ালদহ যাওয়ার আগেও।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মরহুম অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বয়ানে, এর বিরোধিতাকারীদের মধ্যে রয়েছেন আশুতোষ মুখার্জি এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছাড়াও, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার বোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপধ্যায়, অম্বিকাচরণ মজুমদার প্রমুখ। এরা সকলেই ছিলেন কলকাতার অধিবাসী। কিন্তু ঢাকার হিন্দুদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার প্রভাবশালী আইনজীবী ও সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান আনন্দ চন্দ্র রায়, বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু প্রমুখ। তারা মনে করতেন যে, ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দু এলিট শ্রেণীর স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তার গুরুত্ব কমে যাবে।
দুই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে শুধুমাত্র বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ বললে ঢাবির সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব খাটো করা হবে। বঙ্গভঙ্গ রদের আগে থেকেই পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার অল ইন্ডিয়া মুসলিম গঠিত হওয়ার ৩ মাস আগে ১ অক্টোবর ৩৫ সদস্যের একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল সিমলায় বড়লাট লর্ড মিন্টোর সাথে দেখা করেন এবং ৫ দফা দাবিনামা পেশ করেন। এর অন্যতম প্রধান দাবি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদান করেন স্যার আগা খান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নওয়াব মহসিন উল মুলক, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ। ইতিহাসে এটি সিমলা ডেপুটেশন নামে খ্যাত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বলে, ‘সাম্প্রদায়িক মঞ্চে এটি সর্ব বৃহৎ শো।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেসও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে।
১৯১১ সালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ওঠে। ঐ বছরের ১৯ আগস্ট নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরী লর্ড চার্লস ব্রেইলির দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে এই দাবি পুনরায় পেশ করেন। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি একটি প্রতিনিধিদল নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে আবার ঢাবি প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এসব দাবী ছিল ১৯০৬ সাল থেকে উত্থিত দাবির ধারাবাহিকতারই অংশ। অবশেষে বৃটিশ সরকার এই দাবি মেনে নেয় এবং দুইদিন পর ২ ফেব্রুয়ারি ঢাবি প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণা আসে। আবুল মকসুদ ও মুনতাসির মামুনদের মতো চিহ্নিত ঘরানার লেখকরা ঢাবি প্রতিষ্ঠা বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে হাল্কা করে দেখাতে চাইলেও এটি ছিল নওয়াব সলিমুল্লাহ্, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই ফল।
তিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণায় মনে হলো, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ল। এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুর এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে হিন্দু নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ সভা করেন। এসব সভায় বলা হয়, ‘এর ফলে বাঙ্গালী জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বেড়ে যাবে। পূর্ববাংলার মুসলমানরা অধিকাংশই কৃষক। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে আদৌ কোনো উপকার লাভ করতে পারবে না।’ বাবু ত্রৈলোক্য নাথ বসুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষার অবনতি হবে। তাই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নাই।’ সিলেটের বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অশিক্ষিত ও কৃষকবহুল পূর্ববঙ্গের শিক্ষা দানের কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের শিক্ষানীতি ও মেধার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্যই থাকবে না।’
১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসহিবারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল লর্ড হর্ডিঞ্জের কাছে নিম্নোক্ত স্মারকলিপি পেশ করেন। ঐ স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে অভ্যন্তরীণভাবে বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রধানতঃ কৃষক। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোনো মতেই উপকৃত হবে না।’
একটি পয়েন্ট হয়েতো সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সেটি হলো, ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাবি প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণা এলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলো নয় বছর বিলম্বে কেন? এ ব্যাপারে একটি মুখচেনা মহল প্রথম মহাযুদ্ধকে দায়ী করলেও প্রকৃত ঘটনা ছিল, ভারত সরকার এবং বাংলা সরকারের প্রশাসনিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদে পদে প্রতিক‚লতা সৃষ্টি।
চার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতার বয়ান একটি বা দুটি কলামে শেষ করা সম্ভব নয়। এই বিরোধিতার কাহিনী বর্ণনার সাথে সাথে যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন তাদের সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত না করলেই নয়। কারণ সেসব শতবর্ষেরও আগের কথা। পরবর্তী তিন চারটি প্রজন্মের কাছে তারা বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পথে। চলতি মাসের ১ তারিখ ছিল ঢাবির শতবর্ষপূর্তি দিবস। এই দিবসটি সাড়ম্বরে জাঁকজমকের সাথে পালন করা উচিত। এখন করোনা মহামারীর কারণে সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে এলে সেটি করা উচিত। সেজন্য প্রয়োজন হলে দুই এক বছর অপেক্ষা করা যেতে পারে।
তবে গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে, এই জুলাইয়ে শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে মিডিয়ায় যেসব প্রবন্ধ নিবন্ধ ছাপা হয়েছে বা যেসব টক শো সম্প্রচারিত হয়েছে সেগুলোর ৯৮ শতাংশতেই ঐসব মনীষীদের কথা উল্লেখ নাই, যাদের অসাধারণ প্রচেষ্টা ও বিশাল অবদান না থাকলে ঐ বৈরী সময়ে ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হতো কিনা, সন্দেহ। বরং যেসব নাম হাইলাইট করা হয়েছে, সেসব সমকালীন অথবা সাম্প্রতিক অতীতের রাজনীতির আলোকে করা হয়েছে। সেখানে প্রতিষ্ঠাতারা হারিয়ে গেছেন।
১৯১৭ সালের ৭ মার্চ ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে দেয়া ভাষণে ধনবাড়ীর জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাশের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। এরপর ২০ মার্চ আবারও সরকারের কাছে ঢাবি বিল পাশ করার প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯১৬ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বর লাখনৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভাষণদানকালে নওয়াব আলী চৌধুরী বলেন, ‘পাঁচটি বছর কেটে গেল। যুদ্ধ ও আর্থিক সংকটের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও প্রতিষ্ঠিত হলো না। অথচ এই সংকটের মধ্যেও পাটনায় হাইকোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো।’ ১৯১৬ সালের ৩ এপ্রিল বঙ্গীয় আইনসভায় এ কে ফজলুল হক (পরবর্তীতে শেরে বাংলা) বলেন, ‘প্রতি বছর বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ হয় এবং আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু প্রকল্প আর বাস্তবায়ন হয় না। এজন্য বছরের পর বছর তো লাগার কথা নয়। বাস্তবায়নের ইচ্ছা থাকলেই হয়।’
এরমধ্যে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি নওয়াব সলিমুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কয়েক শত বিঘা জমি ঢাবি প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন। অবশেষে ১৯২১ সালের ১ জুলাই নওয়াব সলিমুল্লাহ্র দান করা কয়েক শত বিঘা জমির ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিন ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁরা হলেন, নওয়াব সলিমুল্লাহ, জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।