পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির কিছু বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের টিন বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার আছে। কিন্তু বছর শেষে মাত্র ২০-২২ লক্ষ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকে, যাদের মধ্যে আবার সাত থেকে আট লক্ষ আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি হলো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের উৎসে কর কেটে রাখা হয়। আয়কর রিটার্ন জমা দানকারীদের মধ্যে ১০% আবার শূন্য রিটার্ন জমা দেয়। তার মানে হলো, তারা কোনো কর প্রদান করে না।
সুতরাং কর জিডিপির অনুপাত বাড়াতে তাদের কোনো ভূমিকাই থাকে না। বাংলাদেশে কর জিডিপির অনুপাত মাত্র পৌনে ৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১.১ শতাংশ কর দিয়ে থাকে। ভুটানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১% শতাংশ নিয়মিত কর প্রদান করে থাকে। নেপালের অবস্থান ভুটানের কাছাকাছি। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১ কোটি ৬৪ লক্ষ মানুষ কর প্রদান করে থাকে যা মোট জনসংখ্যার ১.৫ শতাংশ। এদিকে শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ কর প্রদান করে থাকে। পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় বাংলাদেশের সমান।
বাংলাদের মানুষ কর দিতে খুব অনাগ্রহী, তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পদ্ধতিগত জটিলতা, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক আচরণ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজস্ব বিভাগের সমন্বয়হীনতায় বহুমানুষ আয়কর রিটার্ন জমাদানের ক্ষেত্রে ততটা আগ্রহ দেখান না। এদিকে মোট করদাতার দুই-তৃতীয়াংশ মোট ৩২ শতাংশ ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বসবাস করে। এক্ষেত্রে অন্যান্য শিল্পনগরী যেমন বগুড়া, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা নারায়ণগঞ্জ, খুলনা- এই সমস্ত এলাকায় নতুন নতুন আয়করধারি ব্যক্তি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নজরদারির বড়ই অভাব রয়েছে।
একজন ব্যক্তি কর প্রদান করতে তখনই আগ্রহী হবে, যখন সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা যথাসময়ে প্রাপ্ত হবে। রাষ্ট্র যখন তাদের করের টাকার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে। কিন্তু একজন ব্যক্তি কর দিতে তখনই অনীহা প্রকাশ করে, যখন তারা দেখে যে তাদের টাকায় নিয়োগকৃত রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে পাচারকৃত টাকা দিয়ে কানাডার বেগমপাড়া বা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে বাড়ি নির্মাণ করছে এবং অনেকাংশে করদাতাদের সেবা প্রদানের পরিবর্তে হয়রানি করছে, সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতা করছে তখনই মানুষ ট্যাক্স প্রদান থেকে বিরত থাকে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের মাত্র ১.১ শতাংশ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে যা অনেক কম। রাজস্ব আদায়ে বিভিন্নভাবে সরকার মানুষকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। করযোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করে রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা আনায়নে সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন জরুরি সেবা যেমন জমি ক্রয়-বিক্রয়, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ, গাড়ি ক্রয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে করে কিছু মানুষ টিন সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য উৎসাহিত বোধ করলেও করতে পারে। আবার কিছু মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়ে টিন গ্রহণ করবে তাদের প্রয়োজনের তাগিদে। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে করযোগ্য আয়ের সীমা তিনলক্ষ টাকা। তবে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত দেয়া হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। দেশের সব মানুষ যে নিয়মিত কর দেয় তা কিন্তু নয়। কর প্রশাসনের অদক্ষতা অনিয়ম দুর্নীতি ও কর প্রদানের জটিলতার কারণে অনেকেই কর প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। কর বিবরণী সহজিকরণ দীর্ঘদিনের দাবি হলেও তা আজও হয়নি। আসলে দেশের প্রতিটি মানুষ, যাদের ব্যক্তিগত আয়সীমা তিনলক্ষ টাকার ওপরে তাদের প্রত্যেককে করের আওতায় আনা জরুরি। প্রতিবছর অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেন, প্রকৃত আদায় তা থেকে অনেক কম। বাস্তবতা হলো ব্যক্তি করদাতা শনাক্তে রাজস্ব বিভাগের যতটা তৎপর থাকার কথা ছিলো তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাকটা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে তিনলক্ষ টাকা আয় করে এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাহলে তাদের চিহ্নিত করতে না পারার দায়টা কিন্তু রাজস্ব বিভাগের। দেশে এই মুহূর্তে লাখপতি ও কোটিপতির সংখ্যাটা মোটেই কম নয়। অথচ, সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবে তাদেরকে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে রাজস্ব ব্যয় মেটাতে সরকারকে প্রতিবছর ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। জনগণের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
আগেই বলেছি, ব্যক্তি পর্যায়ে যারা নিয়মিত আয়কর দেয় তাদের অধিকাংশই চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা তাদের আয়ের ওপর কর প্রদান করে থাকে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তারা অনেকটা অসহায় বোধ করে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে অনেকেরই ইনকাম থাকে না। ৬৫ বা ৭০ বছর বয়সে সন্তানের কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে অনেকেই কুণ্ঠা বোধ করে। করোনাকালে এমন মানুষদের সংকট আরো প্রকট হয়েছে। কারো কারো সন্তান আবার দেশের বাইরে বসবাস করে। স্থবির যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হয় তারা সন্তানের কাছে যেতে পারছে না, নয়তো সন্তানরা দেশে আসতে পারছে না। অনেক সন্তান আবার বিদেশের আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে বাবামার কথা ভুলেই গেছে। এমন সংখ্যাও কম নয়। এ পরিস্থিতিতে বাবা মার স্থান হয় দেশের কোনো না কোনো বৃদ্ধাশ্রমে।
যারা ব্যক্তিগত আয়ের ওপর নিয়মিত কর দেয় তাদের বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্তের পর সরকার যদি তাদের দেশের সিনিয়র সিটিজিন হিসেবে ঘোষণা করে পেনশন প্রদান করে তাহলে ব্যক্তি পর্য়ায়ে আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। যারা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ততোটা চিন্তিত নয়। কিন্তু যারা ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের ব্যবসা করে, বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে কিন্তু নিয়মিত কর প্রদান করে তাদের পেনশন হিসেবে নিয়মিত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা গেলে তা কর ব্যবস্থপনায় একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাধ্য করে কর আদায় করার দরকার নেই। করা যাবেও না। প্রণোদনা দিন, দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করুন, হয়রানি কমান, অপচয় রোধ করুন, সরকারি টাকার নয়-ছয় বন্ধ করুন, পাচারকারিদের টাকা ফিরিয়ে আনুন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন, দেখবেন, মানুষ আয়কর প্রদান করতে উৎসাহিত বোধ করবে।
একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় গড়ে ৩০-৪০ বছর সরকারকে কর প্রদান করে থাকে। একজন করদাতা তার সারা জীবনে সরকারকে কী পরিমাণ টাকা আয়কর দিয়েছে তার হিসাব নিশ্চয় সরকারের কাছে রক্ষিত আছে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ যদি তাদের পেনশন হিসেবে প্রদান করা হয় তাহলে বিশ্ব দরবারে আমরা কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবো। বৃদ্ধ বয়সে এই প্রণোদনা অনেকেরই কাজে লাগবে না জানি, আবার অনেকের ভীষণভাবে কাজে লাগবে। আজকের করোনা অতিমারিকালীন সময়ে কিছু মানুষের কাছে এমন প্রণোদনা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
দেশের যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে মাঠে ঘাটে ফসল ফলিয়ে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে, যে শ্রমিক কলে-কারখানায় শ্রম দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করেছে তাকে যদি তার বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয় তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে সস্মানিত বোধ করবেন এবং তাদের পেশার প্রতি আরো যত্নশীল হবেন।
আমাদের সিনিয়র সিটিজেন যারা তাদের জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় রাষ্ট্রের কাজে ব্যয় করেছে তাদেরকে বৃদ্ধ বয়সে পেনশন বা আর্থিক প্রণোদনার আওয়ায় এনে রাষ্ট্র তার কৃতজ্ঞতাবোধ জানাতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য কল্যাণমুখী বহু কর্মসূচি চালু রয়েছে। আমরাও আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসা, বাস ট্রেনে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত, বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার প্রদান করতে পারি। সরকারের কাছে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যাদি রয়েছে। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই আমরা আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মানিত করতে পারি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নীরবে বড় ধরনের একটি পরির্বতন ঘটে গেছে। যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে গেছে। ফলে বৃদ্ধ বয়সে বাবামাকে দেখার কেউ থাকে না। তাই যেসব মানুষের টিন সার্টিফিকেট আছে বৃদ্ধ বয়েসে তাদের সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ক্ষেত্র বিশেষে খুবই জরুরি। নিজেদেরকে উন্নত জাতি হিসেবে দাবি করলেও আমরা আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদের আজও সর্বক্ষেত্রে যোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারিনি। বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।