Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

অতিরিক্ত জনসংখ্যা উন্নয়নের অন্তরায়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত হল সে দেশের কাম্য জনসংখ্যা। জনসংখ্যাই নিরূপিত করে জনসম্পদ বা মানবসম্পদকে। দেশের অন্যান্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটানোর জন্য মানব সম্পদের ভূমিকা প্রথম ও প্রধান। উৎপাদনের উপাদান হিসাবে মূলধন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি যা বর্তমানে খুব গুত্বপূর্ণ তাও মানব নির্মিত। তাই মানবসম্পদ উৎপাদনের সর্বপ্রধান উপাদান। এ সম্পদের বিশেষত্ব হল, এ সম্পদের অভাব যেমন উৎপাদনকে ব্যাহত করে, অনুরূপভাবে তার মাত্রাতিরিক্ত প্রাচুর্য প্রকৃত উন্নয়নের পরিপন্থী। তাই একটি দেশের জনসংখ্যাকে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ দু’ভাবে আখ্যায়িত করা যায়।

বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সকল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ বর্তমানে যে সকল আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত, তার প্রত্যেকটির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনস্ফীতি দায়ী। দারিদ্র্য, খাদ্যসঙ্কট, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার নিম্নমান, নিম্ন সঞ্চয় তথা মূলধন গঠন, অপুষ্টি তথা নিম্ন কর্মদক্ষতা ইত্যাদির মূল কারণ অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তা ছাড়া অশিক্ষা, অসামাজিক কর্মকান্ড, সন্ত্রাসবাদ, ভ্রষ্টাচার, নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধির জন্য অধিক জনসংখ্যা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে দায়ী। আর্থসামাজিক সমস্যাবলী ছাড়া বর্তমান বিশ্ব যে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সঙ্কটে সন্ত্রস্ত, তার জন্য দায়ী এ জনসংখ্যা । জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে শিল্পায়ন ও নগরায়ন। বনাঞ্চল তথা অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। বেড়ে চলেছে বায়ু-পানি-শব্দ দূষণ। সারা বিশ্ব আজ গোলকীয় উষ্ণতা বৃদ্ধির হানিকর প্রকোপে চরম উদ্বিগ্ন।

মানব সম্পদের স্বল্পতা যেমন একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে না, অনুরূপভাবে তার মাত্রাতিরিক্ত প্রাচুর্য উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ বর্তমানে এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন। অত্যধিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এসব দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমাজের এক অংশের অগ্রগতি হয়তো ব্যাহত হবে না, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থা আরো নিম্নগামী হতে বাধ্য।

অর্থনীতিবিদ মালথাস তার জনসংখ্যা তত্তে¡ ২০০ বছর পূর্বে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাধারণত একটি দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদনের হারের চেয়ে ঐ দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। এ অবস্থায় মানুষ যদি নিজে থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় অবলম্বন না করে, তা হলে জনসংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এবং শেষ পর্যন্ত তা প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, রোগ, দাঙ্গা, যুদ্ধ ইত্যাদি। যদিও মালথাসের তত্তে¡র সমালোচনা করে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন মালথাস কথিত হারের চেয়ে অধিক করা সম্ভব। তাই মালথাস যে খাদ্যাভাব বা প্রাকৃতিক কারণে জনসংখ্যা হ্রাসের আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন তার সম্ভাবনা নেই।

অতএব, তিনি তাঁর জনসংখ্যা তত্তে¡ যে নিরাশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ চিত্র অঙ্কন করেছেন তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ঠিক যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রারম্ভিক পর্যায়ে উন্নয়নের হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অধিক হতে পারে। তার কারণ হল এ পর্যায়ে উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের তুলনামুলক প্রাচুর্য থাকায় বর্ধিত জনসংখ্যাকে উৎপাদনে নিয়োজিত করে মোট উৎপাদন তথা মাথাপিছু উৎপাদন উভয়ই বৃদ্ধি করা সম্ভব। এমন একটা সময় আসবে যখন মালথাসের তত্তে¡র সত্যতা অনেকটা ন্বীকার করতে হবে। কেননা, অধিকাংশ প্রাকৃতিক সম্পদের জোগান সীমিত। এমনকি যে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ পুনর্নবীকরণযোগ্য সেগুলোর প্রকৃতির উপর অত্যধিক চাপ তথা সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে, বৃদ্ধি একেবারে হ্রাস পেয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা পুনর্নবীকরণ না হয়ে সেগুলো বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যধিক হওয়ায় এক মারাত্মক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলস্বরূপ মোট উৎপাদন বাড়লে মাথাপিছু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা সার্বিক উন্নয়ন সূচিত করে না।

জনসংখ্যা সংক্রান্ত অপর এক তত্তে¡ বলা হয়েছে যে, একটি দেশের জনসংখ্যা কত হওয়া উচিত তা নির্ভর করে ঐ দেশে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ তথা উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের উপর। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে জনসংখ্যা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। একটি দেশে সে পরিমাণ জনসংখ্যা কাম্য, যে পরিমাণের দ্বারা দেশের প্রাপ্ত সম্পদরাজির যথাযথ উৎপাদনমুলক ব্যবহার সম্ভব হয় তার চেয়ে কম ঠিক নয়, বেশিও ঠিক নয়। একে বলা হয়েছে অপটিমাম জনসংখ্যা। বর্তমানে বোধ হয় বাংলাদেশ সহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ সে অপটিমাম জনসংখ্যার মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। এ অবস্থায় জনগণের সার্বিক উন্নয়ন অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের লোকের সমতালে ও সমযাত্রায় উন্নয়ন বলতে গেলে অসম্ভব।

পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা আগামী প্রতি পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছরে দ্বিগুণ হবে। মালথাসের ভবিষ্যদ্বানী এ রকম ছিল। এ পরিমাণ জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান সমস্তরে রাখতে হলে দেশগুলোতে পানি, খাদ্য, জনস্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, বিনোদন ইত্যাদি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ এ সময় সীমার দ্বিগুণ করতে হবে। এ কাজটি কঠিন এবং অসম্ভব । প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে যোগানের ভারসাম্য সাধনের চেষ্টা একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সফল হতে পারে। কাজেই চাহিদাকে যোগানের দ্বারা সীমাবদ্ধ করা আবশ্যক।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে যে আকার ধারণ করেছে, সে অবস্থায় এক বর্গকে বঞ্চিত করে অপর বর্গের উন্নয়ন সম্ভব, সার্বিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে বর্তমানে অত্যধিক জনবহুল দেশে প্রকৃতপক্ষে এ রকম ঘটছে। মোট উৎপাদন ও জাতীয় আয় বাড়ছে ঠিক কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটছে না। এক শ্রেণীর মানুষ উন্নতির চরমে পৌঁছালেও বিরাট সংখ্যক মানুষ উন্নতির আলো থেকে বঞ্চিত। এক শ্রেণীর মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বজালে জড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে, অপরদিকে আজো বিরাট সংখ্যক মানুষের বিদ্যুৎ নামক বস্তুর সঙ্গে পরিচিতি ঘটেনি। যেখানে এক শ্রেণীর মানুষ বোতল ভর্তি মিনারেল ওয়াটার দিয়ে শৌচকর্ম সমাধান করছেন, সেখানে বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে প্রকৃতি প্রদত্ত পানিটুকু ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এটাকে প্রকৃত সার্বিক উন্নয়ন বলা যায় না।

একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে উৎপাদনের উপর, উৎপাদন নির্ভরশীল সম্পদের লভ্যতার উপর। উৎপাদন সংগঠিত হয় মানব তথা অন্যান্য সম্পদের এক নির্দিষ্ট অনুপাতে ব্যবহারের মাধ্যমে। বর্তমানে একদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান, অপরদিকে মানবসম্পদের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। ফলে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে তাতে মোট উৎপাদন বাড়লে মাথাপিছু উৎপাদন বা আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় একটি দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি সূচিত করে না। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অতিরিক্ত জনসংখ্যা
আরও পড়ুন