Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এই অসচেতনতার শেষ কোথায়?

প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের কান্না ও আহাজারি যেন আমাদের অনেকটা গা সহা হয়ে গেছে। এমন কিছু দুর্ঘটনাও থাকে যা হৃদয় বিদীর্ণ করে, মন জর্জর করে। গত শুক্রবার কারওয়ান বাজারে মাদরাসা ছাত্র ১০ বছরের ছোট্ট শিশু রবিউল আউয়াল জুমার নামাজ পড়া শেষে রাস্তা পার হতে গিয়ে দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারায়। সে বাসায় ফিরছিল। তার মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। পুত্র এলে তাকে খাইয়ে দেবে। শিশুটি মায়ের কোলে ফেরেনি। রাস্তায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে। এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। পাঁচ বছর আগে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হামিমের মৃত্যুও আমাদের নাড়া দিয়ে গেছে। মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেপরোয়া বাস তাকে চাপা দিয়ে মায়ের হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ফুলের মতো ছোট্ট হামিমের নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে মন হাহাকার করে উঠে। মানুষের হৃদয় মথিত করে। এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিদিনই আলোচনা হচ্ছে। প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণের কথাও বলা হচ্ছে। দুঃখের বিষয়, সড়ক বিভাগ, ট্রাফিক বিভাগ, পরিবহন মালিক, চালক থেকে শুরু করে যাত্রী ও পথচারী কেউই সচেতন হচ্ছে না। মানুষের জীবন ও নিজের জীবন নিয়ে এমন হেলাফেলা ও উদাসীনতা খুব কম দেশেই দেখা যায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকেও দুর্ঘটনার কারণ নিরসন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। সড়ক পথে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা অব্যাহতভাবেই চলছে এবং প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের অসহনীয় আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে।
গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের ফটোফিচারে দেখা যায়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করছে। পথচারী প্রবেশ ও চলাচল নিষিদ্ধ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড থাকলেও তার পাশ দিয়ে পথচারী অবাধে চলছে। বলাবাহুল্য, ফ্লাইওভারে যানবাহন থামানো বা পথচারী চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। এগুলো নির্মিতই হয় দ্রুত চলাচলের জন্য। এখানে যানবাহন থামা বা পথচারীদের হাঁটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ আমাদের দেশের ফ্লাইওভারগুলোতে এ চিত্র এখন নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে এক হানিফ ফ্লাইওভারেই একাধিক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার পরও প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা যে নেয়া হয়নি, তা ইংরেজি পত্রিকাটির ফটোফিচার থেকে প্রমাণিত হয়। এমন অনিয়ম ও অসচেতনতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। এই যদি হয় পরিস্থিতি তবে দুর্ঘটনা না ঘটার কোনো কারণ থাকতে পারে না এবং স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিও থামবে না। রাস্তা পারাপারে পথচারীদের অসচেতনতার বিষয়টি নতুন নয়। এলোপাতাড়িভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়িচাপা পড়ে কতজনের যে প্রাণ গিয়েছে, তার কোনো হিসাব নাই। এমনও দেখা গেছে, রেল লাইন ধরে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছে পথচারী, ট্রেন যে হুইসেল বাজিয়ে আসছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। অনিবার্যভাবে ট্রেনের নিচে পড়ে তার প্রাণ গেছে। এরকম একাধিক ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে। দেখা গেছে, যেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে পরদিনই সে স্থান দিয়ে পথচারী একইভাবে চলাচল করছে। কোনো ধরনের সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পথে পথচারীদের এলোমেলোভাবে পার হওয়ার দৃশ্য নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ দৃশ্য নিবৃত্ত করার জন্য ট্রাফিক বিভাগের যেমন কোনো মাথাব্যথা নেই, তেমনি যারা পার হচ্ছে তাদেরও কোনো চেতনা নেই। এতে আমাদেরকে প্রায়ই দুর্ঘটনার মর্মান্তিক খবর শুনতে হয়। অথচ পথচারীদের চলাচলের জন্য যেমন ফুটপাত রয়েছে, তেমনি রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ও নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। এগুলো এখন নামকাওয়াস্তে হয়ে পড়েছে। খুব কম লোকই এগুলো ব্যবহার করে। এমনকি কোনো কোনো ফুটওভার ব্রিজ গাছপালা, লতাপাতা ও ফুলের টব দিয়ে সাজানো এবং বনানীসহ কয়েকটি জায়গায় ফুটওভার ব্রিজে উঠার জন্য এসকেলেটরও বসানো হয়েছে। এসবের কোনো কিছুই পথচারীদের আকৃষ্ট করেনি। অন্যদিকে এমনও ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে যেগুলো ব্যবহার না করতে করতে নষ্ট ও পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কয়েক মাস আগে ফুটওভার ব্রিজ ও নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পথচারীদের চলাচলে বাধ্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। কারওয়ান বাজার ও বাংলামটরসহ কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতও বসে। যারা নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে পার হয়নি তাদের জরিমানাও করা হয়। এ নিয়ে বিতর্ক উঠায় তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ রাস্তায় চলাচল করার মতো নাগরিক সচেতনতা যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি রাস্তায় চলাচলের নিয়ম শৃঙ্খলা গড়ে তোলার যথাযথ ও কার্যকর একটি সিস্টেমও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে পারেনি। ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে চলে গেছে। রাস্তা দখল করে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে। গণপরিবহনগুলো যেখানে সেখানে থামছে, চলতি অবস্থায় যাত্রী উঠা-নামা করছে। এসব অনিয়ম প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। রাস্তায় নিয়ম শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই। এমন বিশৃঙ্খল ও অসচেতন পরিস্থিতি কোনো সভ্য দেশে কল্পনাই করা যায় না।
অনাকাক্সিক্ষত ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এড়াতে সবার আগে সড়ক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। যানবাহন চলাচল থেকে শুরু করে পথচারী চলাচলে যুগোপযোগী নিয়ম শৃঙ্খলা তৈরি করে তা কীভাবে কার্যকর এবং মানতে বাধ্য করা হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। যেসব অনিয়ম চলছে সেগুলো কঠোর হস্তে প্রতিরোধ করতে হবে। গণপরিবহন থামা এবং পথচারী চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়মিত মনিটরিং কার্যকর করতে হবে। আইন সম্পর্কে মানুষকে জানানো এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দুর্ঘটনার করুণ চিত্র নিয়ে সারা বছর ধরে গণমাধ্যমগুলোতে নাটিকা সম্প্রচার এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ভিত্তিতে ভলান্টিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পথচারীদের চলাচলের ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যারা পথে চলাচল করেন, নিজের জীবন ও পরিবারের স্বার্থে তাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এই অসচেতনতার শেষ কোথায়?

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন