পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ শিশুশিক্ষার্থীদের মসজিদ-মক্তবে শিক্ষা আরম্ভ হয়। পবিত্র কোরআন শিক্ষা লাভের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন সূচিত হয়। পরবর্তীতে কেউ প্রাইমারি স্কুলে, কেউ মাদরাসায় চলে যায়। সাধারণ শিক্ষায় যেমন প্রাইমারি স্কুল, তেমনি মাদরাসা শিক্ষায় এবতেদায়ি মাদরাসা। দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের যোগান দেয় প্রাথমিক পর্যায়ের এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাইমারি স্কুল কিংবা এবতেদায়ি মাদরাসায়, শিশুশিক্ষার্থীরা যেখানেই পড়ুক না কেন, সেখানে যাতে তারা ভালোভাবে, সুষ্ঠুভাবে লেখাপড়া শিখতে পারে তার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ দুঃখজনক হলেও লক্ষ করা যায়, এবতেদায়ি মাদরাসাশিক্ষা পদে পদে অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। পক্ষান্তরে যথেষ্ট মনোযোগ ও সাপোর্ট পাচ্ছে প্রাইমারি শিক্ষা। এই মনোযোগ ও সাপোর্ট দেয়াতে দোষের কিছু নেই। বরং এটাই প্রত্যাশিত। একইভাবে অনুরূপ মনোযোগ ও সাপোর্ট এবতেদায়িও দাবি করে। এই দাবি পূরণ না হওয়াতে যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, তাতে হতাশাক্রান্ত হচ্ছে এবতেদায়ির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এটা কি কল্পনা করা যায় যে, এবতেদায়ির কিছু সংখ্যক শিক্ষক সামান্য বেতন-ভাতা পেলেও অনন্ত অর্ধলক্ষ শিক্ষক-কর্মচারি কিছুই পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান আছে, তারা দায়িত্ব পালন করছেন; অথচ বেতন-ভাতা বলে কিছুই পাচ্ছেন না। তারা কীভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করছেন, সেটা অবশ্যই একটা বড় প্রশ্ন। ক্ষুধা, যন্ত্রণা, হতাশা অনেক কিছুই তাদের আক্রান্ত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বেতন-ভাতা না থাকায় ইতোমধ্যে ১৪ হাজার এবতেদায়ি মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে বাকীগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ড প্রায় ১৮ হাজার স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই ১৪ হাজার মাদরাসা রয়েছে। ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য প্রতি মাসে ৫০০ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫১৯টি মাদরাসার ৩০৩২ জন শিক্ষককে ওই টাকা প্রদানের মাধ্যমে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরবর্তীকালে তাদের বেতন সামান্য কিছু বাড়ানো হলেও ’৯১ সালের ৫০০ টাকার ভ্যালু এখন কত, সে অনুযায়ীও বাড়ানো হয়নি। এর চেয়ে ঠকানো আর কিছু হতে পারে না। আর যারা বছরের পর বছর বেতন-ভাতা বলতে কিছুই পাচ্ছেন না, তাদের বঞ্চনার কোনো তুলনা হয় না। শুধু এবতেদায়ির শিক্ষক-কর্মচারিরাই নন শিক্ষার্থীরাও চরম বৈষম্যর শিকার। এবতেদায়ির সমমানের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রণোদনা ও সহযোগিতা দেয়া হয়। যেমন, তাদের দুপুরের খাবার হিসেবে দুধ, ডিম, বিস্কিট ইত্যাদি দেয়া হয়। তাদের উপবৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি দেয়া হয়। অথচ, এবতেদায়ির শিক্ষার্থীদের জন্য এসবের কিছুই দেয়া হয় না। এর চেয়ে মর্মান্তিক বৈষম্য আর কী হতে পারে!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। একই সঙ্গে তিনি মাদরাসা শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগী। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠায় তার প্রচেষ্টার কথা কারো অজানা নেই। স্মরণ করতে পারি, ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি সমাবেশে তিনি স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার নির্দেশ পালন করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাদের। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন, স্বীকৃতি, পরিচালনা, জনবল কাঠামো ও বেতন-ভাতাদি-অনুদান সংক্রান্ত, নীতিমালা জারি করা হলেও গত আড়াই বছরে তা বাস্তবায়নের সময় হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ধামাচাপা দেয়া কিংবা উপেক্ষা করার দুঃসাহস কারা দেখিয়ে যাচ্ছেন, আমরা জানি না। এবতেদায়ির নীতিমালা অনুমোদিত হওয়ার পরও যারা বাস্তবায়নে বিলম্ব করছেন, তারাই বা কারা, তাও আমাদের জানা নেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দফতর ও বিভাগে এমন কিছু লোক থাকতে পারেন, যারা মাদরাসা শিক্ষার বিকাশ-বিস্তারের বিরোধী। তারাই ভেতর থেকে ঘুঁণ পোকার কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন; যাদের প্রতি যে নির্দেশ দেন, তা পালন করা তাদের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সব সময় সব কিছু খোঁজ-খবর রাখা কিংবা সবকিছু করা সম্ভব নয়। শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে যারা নীতিনির্ধারক আছেন, দায়িত্বশীল আছেন, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যকের মাদরাসা শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার প্রতি এলার্জি আছে। তারাই সবকিছুর কলকাঠি নাড়ছেন। এটাই স্বাভাবিক, বেতন-ভাতা না পেলে এক সময় সব এবতেদায়ি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে মাদরাসা শিক্ষাধারার উপর পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেবে। আর শিক্ষার্থী সংকটে একের পর এক মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে ঐতিহ্যবাহী ও অতিপ্রয়োজনীয় মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাই শেষ হয়ে যাবে। বুঝা যায়, অপরিণামদর্শী ও বিদ্বেষী বা গাছকাটা গোড়া থেকেই শুরু করেছেন। এবতেদায়ির বর্তমান অবস্থাই তার সাক্ষ্য দেয়।
মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভূমিকার কথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই। এ দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা এটি। দ্বীনী শিক্ষা ছাড়াও দুনিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, আইন, ভাষাবিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা ইত্যাদি এই শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখনো কমবেশি আছে। আধুনিক ও মাদারাসা শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টাও চলছে; শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও। আমাদের সমাজের কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচন্ড অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তার দায় শিক্ষাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে যা বুঝি, তা থেকে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। সে কারণে কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হয়েছে, ৮০ শতাংশ কিশোর-তরুণ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। জাতির ভবিষ্যতের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ অশনিসংকেত আর কিছু হতে পারেনা। আলহামদুলিল্লাহ, মাদরাসাশিক্ষার্থীরা এসব থেকে মুক্ত। এটা মাদরাসা শিক্ষার একটি বড় সুফল। মাদরাসা নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। সৎ-চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষার কতটা প্রয়োজন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আমরা আশা করবো, এবতেদায়িসহ মাদরাসা শিক্ষার প্রতি যে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে, অবশ্যই তার যথাযথ প্রতিবিধান করা হবে। এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের যথার্থ মূল্যায়ন ও উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে ভূষিত করতে হবে। এর নীতিমালা কালবিলম্ব না করে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা আরো আশা করবো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিকে সুদৃষ্টি দেবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।