Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

৬ দফা স্বাধীনতার সনদ : ৭০ এর নির্বাচন ছিল সেই সনদের পক্ষে গণরায়

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

গত ৮ জুন দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলামে প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল, ৬ দফার ভেতরেই নিহিত ছিল স্বাধীনতার ১ দফা’। খবরে বলা হয়, ‘ঐতিহাসিক ৬ দফার ভেতরেই স্বাধীনতার ১ দফা নিহিত ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, ৬ দফা মানেই এক দফা। অর্থাৎ স্বাধীনতা।’

গতকাল ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত (রেকর্ডকৃত) একটি অনুষ্ঠানে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এই ছয় দফার ভেতরেই এক দফা নিহিত ছিল। সেটা আমরা, পরিবারের সদস্যরা, জানতাম। তিনি সব সময় বলতেন, ছয় দফা মানেই এক দফা। অর্থাৎ স্বাধীনতা। আজ আমরা সেই স্বাধীন জাতি। কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন করতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন শহীদ হওয়াদের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙ্গালী জাতি ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যে চিন্তা-চেতনাগুলো তার (বঙ্গবন্ধু) ভেতরে ছিল, সেটা ছিল সঠিক। তিনি জানতেন, নির্বাচনই স্বাধীনতার একমাত্র পথ।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে। সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে অনেক দল ও অনেক মত থাকবে। সেটাই গণতন্ত্রের বিউটি বা সৌন্দর্য। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাস ভবনে বিরোধী দলসমূহের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। ঢাকা বিমান বন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের কাছে সংক্ষিপ্ত আকারে ছয় দফা বর্ণনা করেন।

যিনি যত কথাই বলুন না কেন, রাজনীতি নিয়ে যত মত পার্থক্যই থাকুক না কেন, যখন বলা হয় যে, ছয় দফার মধ্যেই এক দফা নিহিত ছিল তখন সেই কথা, সেই বক্তব্য বা ছয় দফার সেই ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমতের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনেকগুলো দিকের সাথে একমত নই। কিন্তু যখন বলা হয় যে, ৬ দফা হলো তদানীন্তন পূর্ব বাংলার (১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীন হওয়ার সনদ, তখন আমি তার সাথে একমত। ১৯৬৬ সালে আমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। তখন অফিস সময় ছিল সকাল ৭-৩০ মি. থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। তখন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানের অবজার্ভার পত্রিকার মালিক। অবজার্ভার হাউজ থেকে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা বের করা হয়। পত্রিকাটির নাম ছিল দৈনিক পূর্বদেশ। সম্পাদক ছিলেন মাহবুবুল হক। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্যও ছিলেন। আমি পূর্বদেশে উপসম্পাদকীয় কলাম লিখতাম। কলামটির নাম, ‘দেশে বিদেশে’। লেখক ‘পর্যটক’ (ছদ্মনাম)।

এর মাত্র দু’ বছর আগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করি। ১৯৬৬ সালের জুন অথবা জুলাই মাসে ছয় দফার ওপর একটি বুকলেট আমার হাতে আসে। ছয় দফার প্রতিটি দফা এবং উপদফা আমি গভীর মনোযোগের সাথে পড়ি। অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে ছয় দফার অর্থনৈতিক দফাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার পর আমি বুঝতে পারি যে, ছয় দফা আর যাই হোক, একটি ফেডারেশন বা ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিফলন নয়। এটি একটি কনফেডারেশনের প্রতিবিম্ব। কনফেডারেশন গঠিত হয় দুই বা ততোধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে। কনফেডারেশনভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ যখনই মর্জি হবে তখনই কনফেডারেশন থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। সোজা কথা, কনফেডারেটিং ইউনিটগুলোর Willing Consent এর ওপর কনফেডারেশনের অস্তিত্ব নির্ভর করে।

দুই
অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় যে, ছয় দফার মাধ্যমে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সত্ত্বা, অর্থাৎ স্বাধীন দেশ হিসাবে গড়তে চেয়েছিলেন। আমরা যদি ছয় দফার দফাওয়ারী বিশ্লেষণে যাই তাহলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।

প্রথম প্রস্তবেই বলা হয়েছে যে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা হবে। লাহোর প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। লাহোর প্রস্তাবে একাধিক তথা দুইটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা ছিল। এক রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের ধারণা আসে ১৯৪৬ সালের ৭ এপ্রিল দিল্লী কনভেনশনে। ১৯৪০ সালে লাহোরের লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। আর ১৯৪৬ সালের দিল্লী কনভেনশনে এক রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দুই জনই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। ছয় দফার ‘শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতিতে’ বঙ্গবন্ধু লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র- এই চৎবসরংব বা ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন।

৩ নং প্রস্তাবে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই মুদ্রা রাখার কথা বলা হয়েছে। এক দেশে দুই মুদ্রা থাকে না। বলা হয়েছে যে, দুই মুদ্রা অবাধে বিনিময়যোগ্য হবে। আমি যখন নেপালে যাই তখন আমার হাতে ভারতীয় মুদ্রা ছিল। ভারতীয় মুদ্রা দিয়ে আমি নেপালে কেনাকাটা করেছি। অর্থাৎ দুটি স্বাধীন দেশ, নেপাল ও ভারতের মুদ্রা অবাধে বিনিময়যোগ্য ছিল। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে সব সময় বাংলাদেশ বলতেন। ১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত হয় তখন পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়। শেখ মুজিব এই নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ নাম সব সময় উচ্চারণ করেন।

৪নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের কর ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর ধার্যের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। এটি কোনো ফেডারেল ব্যবস্থা বা এক রাষ্ট্রের ব্যবস্থা নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের কোনো উৎস নাই। বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রদেশের চাঁদার ওপর চলবে কেন্দ্রীয় সরকার।

৫নং প্রস্তাবে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ ও অন্যান্য কনফেডারেল ইউনিটের থাকবে। বহির্বাণিজ্যে কেন্দ্রের কোনো এখতিয়ার থাকবে না। বাংলাদেশের নিজস্ব রিজার্ভ সিস্টেম থাকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের নিজস্ব স্টেট ব্যাংক থাকবে। বাংলাদেশের আমদানী আয়ের ওপর কেন্দ্রের কোনো প্রকার কর্তৃত্ব থাকবে না।
এসব পড়ে আমি কনভিন্সড হই যে, ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবি। কৌশলগত কারণে স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে না। আর সে কারণেই আমি পূর্বদেশে ছয় দফার বিরুদ্ধে একটি কথাও লিখিনি।

তিন
এগুলো তো হলো আমার মত ছা পোষা একজন কলামিস্টের বিশ্লেষণ। এখন দেখা যাক সেই সময় দেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. নূরুল ইসলাম ছয় দফা সম্পর্কে কি বলেছেন। সেই সময় সাবেক পাকিস্তানের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হিসাবে ৪ জনের খুব নাম ডাক ছিল। এরা হলেন, ড. নূরুল ইসলাম, ড. আখলাকুর রহমান, ড. আনিসুর রহমান এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহান। ড. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘ছয় দফা যদি আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়িত হতো তাহলে পাকিস্তান এক থাকতো না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেন। ১৯৭৫ সালের পর থেকে তিনি অর্থনীতিবিদ এবং ফেলো হিসাবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, জাতি সংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় সহকারী মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক খাদ্য বগেষণা ইনস্টিটিউটের এমিরেটাস ফেলো ছিলেন। এখন তিনি আমেরিকার মেরিল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

৬ দফা যেহেতু স্বাধীনতার অনুক্ত কর্মসূচী তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফল ছিল সেই স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণের রায় তথা ম্যান্ডেট। জনগণের রায় থেকে শেখ মুজিবের পিছু হটার কোনো পথ ছিল না। এ ব্যাপারে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় ড. নূরুল ইসলামের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। শিরোনাম, ‘৬ দফা নিয়ে কোনো আপোষের সুযোগ ছিল না।’ (পৃ: ১৮)। ড. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য স্বার্থ ও আকাঙ্খা রক্ষা করে পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে টিকিয়ে রাখার আর কোনো উপায় ছিল না। আপোষ করে পাকিস্তানের সাথে আরো দীর্ঘ সময় থাকার ব্যাপারটি কোনো ফল বয়ে আনতো না। বরং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময়টি হারিয়ে যেত। দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল তা হারিয়ে যেত। যে কোনো ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি আপোস আরো অনেক আপোষের দিকে নিয়ে যেত। পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ত।’
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পর অধুনা দৈনিক ‘পূর্বদেশে’ আমি লিখেছিলাম, ‘এই নির্বাচনী ফলাফল পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেললো।’ সে কারণে ২৩/২৪ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
[email protected]



 

Show all comments
  • Dadhack ১৬ জুন, ২০২১, ১২:৫১ পিএম says : 0
    মুসলিমদের একদফা কোরআন দিয়ে দেশ শাসন করা আজকে কোরআন দিয়ে দেশ শাসন করা হচ্ছে না বিধায় হত্যা খুন গুম ধর্ষণ চাঁদাবাজি যত ধরনের অন্যায় অবিচার সরকার করেই যাচ্ছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন