পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সাবেক সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালকসহ, নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এক কীর্র্তিমান পুরুষ শাহ আব্দুল হান্নান। গত ২ জুন রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণের অনন্য কারিগর শাহ আবদুল হান্নানের সদর্প অথচ নীরব পদচারণা ছিল সরকারি কর্মকান্ডের বাইরে সমাজের নানা ক্ষেত্রে। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি একজন ব্যক্তিমাত্র নন, একটি প্রতিষ্ঠান। আমার সৌভাগ্য হয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে তাঁর ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাছ থেকে দেখার। যতই দেখেছি ততই তাঁর চরিত্র মাধুর্য্যে বিমোহিত হয়েছি। তার প্রতিটি কথা চম্বুকের মতো আকর্ষণ করতো। তিনি ছিলেন সুন্দর আচরণের মডেল। তাঁর কথা ও কাজে কোন ফারাক দেখেনি। কখনো তাঁর মুখ থেকে মন্দ কথা ও কারো বদনাম শুনিনি। তিনি ছিলেন, খুবই লাজুক এবং নম্র স্বভাবের। সোজা সাপটা একজন মানুষ ছিলেন। নির্ভেজাল স্পষ্টবাদীও ছিলেন। কথা শুরু করার আগে ভূমিকা নিয়েও ভাবতেন না। যা বলার সরাসরি বলতেন। ঘন্টাব্যাপী বক্তব্য দিতে পছন্দ করতেন না। প্রয়োজনীয় বক্তব্যটি পেশ করতেন। অল্প কথায় সব বলে ফেলতেন। লেখার ক্ষেত্রেও বড় করে লিখতেন না। মুল কথাগুলো লিখতেন। কারও ব্যাপারে মন্দ ধারণা কখনো পোষণ করতেন না। শাহ আবদুল হান্নান জীবনের সব ঘটনা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে তাঁকে যতটুকু জেনেছি, তা অসাধারণ। যারা তাঁর অধীনে কাজ করেছেন তারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, তাঁর মতো এমন অভিভাবক খুব কম দেখা যায়। ধমকের সুরে কিংবা ক্ষমতার দাপটে অধীনস্তকে শাসিয়েছেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। অফিসের বসের আচরণে যেখানে অধীনস্তরা ভয়ে থাকে, সেখানে তাঁকে দেখলে আগ বাড়িয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সামনে এসে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। কারণ তিনি কখনো পদ-পদবীর দাপট দেখাতেন না। যত মানুষের সাথে তার সর্ম্পক ছিল সবাই ভাবতো তিনি বুঝি তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
২০০৯ সাল থেকে আমি ইবনে সিনায় কর্মজীবন শুরু করি। তখন থেকে শাহ আব্দুল হান্নান চাচার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তবে সারাক্ষণ কাছে থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ হয় ২০১৭ সালে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী হওয়ার পর। ইবনে সিনা ছেড়ে হলাম তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী। সেই সুবাদে আল্লাহতায়ালা আমাকে সুযোগ করে দেন তাঁর সাথে সারাক্ষণ থাকার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর সান্নিধ্যে থাকতাম। প্রায়ই রাতের বেলায় মশারি টানিয়ে যখন চলে আসতাম, তখন মনের ভেতরে একটা কষ্ট অনুভূত হতো। মনে হতো কি জেনে ছেড়ে এসেছি। সকালে যখন তাঁর রুমে প্রবেশ করতাম, তখন আমাকে দেখেই বলতেন, আমার ছেলে চলে এসেছে। লাইট জ্বালাও। দেখো কোন কোন পত্রিকা এসেছে। আজ কোন বিষয়ে লিখবে ঠিক করে নাও। দিনের করণীয় ঠিক করো। এরপর আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেন। পত্রিকায় আমার কোনো লেখা প্রকাশ হলে খুবই খুশী হতেন। বলতেন, তোমার লেখাটা আগে আমাকে পড়ে শোনাও। যখন জিজ্ঞেস করতাম, কেমন হয়েছে? প্রায়ই বলতেন খুবই ভালো হয়েছে। একদিন বললাম, সবই তো আপনি ভালো বলেন। কিন্তু সব লেখা তো আর ভালো হয় না। তখন তিনি হেসে বলতেন, ‘আমি যদি তোমাকে আমার লেখার সমালোচনা করতে বলি, তাহলে তুমি প্রতিটি লাইনের সমালোচনা করতে পারবে। আমাদের কাজ হচ্ছে লিখে যাওয়া। সমালোচনা করা নয়। কারও সমালোচনা করলে প্রতিটি লাইনের সমালোচনা করা যাবে।’ এভাবে উদার কৌশলে তিনি শিক্ষা দিতেন। মধ্যমপন্থা অবলম্বন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারো সাথে বিরূপ মনোভাব পোষণ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। মানুষকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। মাঝেমধ্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে চারপাশের মানুষকে নসিহত করতেন। কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে। তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন, ‘যোগ্য হতে হবে’। আমি একদিন জিজ্ঞেস করছিলাম, চাচা, সবকিছুর তো সূত্র আছে। তবে যোগ্য হওয়ার সূত্র কী? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ‘বেশি করে পড়তে হবে। মনটাকে উদার রাখতে হবে। মানুষকে বেশি করে ভালোবাসতে শিখতে হবে। জটিল-কুটিল মন-মানসিকতা পরিহার করতে হবে। অন্যের দোষ কিংবা সমালোচনা পরিহার করতে হবে। মানুষকে ক্ষমা করে চলতে হবে।
শাহ আব্দুল হান্নান নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং তাদের অগ্রগতির জন্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে নারীদের সচেতন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে গেছেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে হিজাব কিনে মহিলাদের মধ্যে বিলি করেছেন। দুস্থ, অসহায়, মানসিকভারসাম্যহীন মহিলাদের কিভাবে উপকার করা যায়, চিকিৎসার খরচ কিভাবে কমানো যায়, দারিদ্র্য কিভাবে নিরসন করা যায়, সুদ কিভাবে বন্ধ করা যায়, করজে হাসানা কিভাবে দেয়া যায়, যাকাত ও উশর কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, এই বিষয়গুলি সারাক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করতেন। এর বাইরে আরও কিছু কাজ বিশেষভাবে করার জন্য বলতেন। অবিরাম পড়া, দাওয়াতী কাজ করা, নিজে কিছু লেখা এবং ভালো কোনো লেখা বিলি করা এবং সংগঠন করা কিংবা সংগঠনকে সাধ্যমত সাহায্য করা ইত্যাদি। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা বিষয়ের ওপর তিনি নজর রাখতেন। তার ওপর মন্তব্যদর্শী লেখা লিখতেন। আমাকে প্রায়ই বলতেন সামাজিক ইস্যু নিয়ে লেখা বন্ধ করা যাবে না। লেখা বিলি বন্ধ করা যাবে না। চালিয়ে যেতে হবে। তিনি যেখানেই যেতেন হাতে কিছু লেখা নিয়ে যেতেন। সবার মাঝে লেখা বিলি করতেন। এক কথায় দাওয়াতী কাজ করা ছিল তার মিশন। আমার বিশ্বাস তার পান্ডিত্যপূর্ণ লেখা দেশ ও জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার ইন্তেকালে জ্ঞানচর্চায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণীয় নয়।
লেখক : শাহ আব্দুল হান্নানের ব্যক্তিগত সহকারী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।