Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়ার খেসারত

প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ঢাকার যানজট নিরসন, গণপরিবহনে পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে আশা জাগানিয়া প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বাস্তবায়ন থেকে সরে যাচ্ছে সিআরসিসি বা চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন। ডেভেলপার ও পরামর্শক কোম্পানী ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানী এখন নতুন করে ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট কনস্ট্রাকশন) কোম্পানী পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে একটি দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানীকে নতুন ইপিসি কন্ট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিগত মহাজোট সরকারের আমলে প্রথম পিপিপি বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এ ধরনের প্রকল্প এখনো তেমন সাফল্য পায়নি। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রথম পিপিপি প্রকল্প হিসেবে গণ্য হচ্ছে। চীনা অর্থায়নের শর্ত হিসেবে টেন্ডার ছাড়া, প্রতিযোগিতাহীনভাবে সিআরসিসি’কে ১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দেয়ার পরও হঠাৎ করেই তার এই পিছটান কিছুটা রহস্যময় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে এই প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয়ের অন্যতম যোগানদাতা চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও বিনিয়োগ থেকে সরে যাচ্ছে বলে গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। মোট ব্যয় বরাদ্দের ২৭ ভাগ বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংস্থান করবে এবং অবশিষ্ট অর্থের মধ্য থেকে প্রথম দফায় ৭৫ কোটি ডলার ছাড় করার কথা থাকলেও চীনা ব্যাংকটি এখন এই বিনিয়োগ থেকে সরে যেতে চাইছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটি নিশ্চিতভাবেই ঝুলে যেতে বসেছে। নতুন বিনিয়োগ ও ইপিসি নিয়োগ সাপেক্ষে সময়মতো প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা নিয়ে এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
পদ্মাসেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ফোরলেন প্রকল্পসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পের শুরুতে অথবা মাঝপথে হোঁচট খাওয়ার আরো একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইতিপূর্বে টেলিযোগাযোগ খাতের একটি প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল চীন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। বাংলাদেশের মহাসড়ক, সেতু ও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা সরকার, চীনা কোম্পানী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আশির দশক থেকে বিভিন্ন নদীর উপর চীনের নির্মিত সেতুগুলো চীন-বাংলা মৈত্রী ও বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সরকার দেশকে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব করে তুলতে সচেষ্ট রয়েছে। তবে এসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট তাড়াহুড়া ও অস্বচ্ছতা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনিয়ম-অদক্ষতা ও শৈথিল্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বিনা টেন্ডারে এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ হারে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণের পরও বিনিয়োগ প্রত্যাহার, অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ অথবা মাঝপথে এসে প্রকল্প বাস্তবায়ন ঝুলে যাওয়ার উদাহরণ নজিরবিহীন, হতাশাজনক। গত বছর সমাপ্ত টঙ্গী-ভৈরব রেলপথের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণব্যয় হয়েছিল ৩৮ কোটি টাকা, অথচ বিনা টেন্ডারে একটি চীনা কোম্পানীকে পদ্মাসেতুর দুই পাশে রেলপথ নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ১৪২ কোটি টাকা। চীনা বিনিয়োগের শর্ত হিসেবে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানীকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও একাধিক চীনা কোম্পানীর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়া হলে প্রকল্প ব্যয় যেমন আরো কমত, সেইসাথে দরপত্রের চুক্তি অনুসারে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত হতো।
সাম্প্রতিক সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেই কার্যত বিনা টেন্ডারে অথবা প্রতিযোগিতাহীনভাবে চীন, আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া, জাপান ও ফরাসি কোম্পানীকে কাজ দেয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক উচ্চহারের প্রকল্পব্যয় বরাদ্দের পরও চীনা কোম্পানীগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার প্রভাব অন্যান্য প্রকল্পেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে বিশেষ অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর দক্ষিণ-পূর্বাংশের শনির আখড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ অংশত ২০১৮ সালের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও নতুন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এখন বিলম্ব ও বাড়তি জটিলতায় পড়তে যাচ্ছে। সরকারের একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হিসেবে ২০১১ সালের এপ্রিলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাইলিংয়ের কাজ হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ এবং সামগ্রিক প্রকল্পের বাস্তবায়নে শতকরা ৭ ভাগ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে বাস্তবায়নকারী ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানীর তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে। অর্থাৎ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পটিও অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রতা এবং মাঝপথে হোঁচট খাওয়ার বিড়ম্বনার সম্মুখীন হল। একাধিক কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে সময় বেশি লাগবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, তা খোঁড়া যুক্তি হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। মূলত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে ও বিনা টেন্ডারে বড় প্রকল্পের কাজ পাওয়ার কারণেই এখন চীনা কোম্পানী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। প্রকল্পব্যয় না বাড়িয়ে পরিকল্পিত সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে কোনো দেশি-বিদেশি কোম্পানীকে বিনা টেন্ডারে যে কোনো প্রকল্পের কাজ দেয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, গতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক।

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়ার খেসারত
আরও পড়ুন